তিতাস গ্যাসে সেবার মান তলানিতে, ঘুষ না দিলেই হয়রানি
তিতাস গ্যাসের অনৈতিক আবদার অবহেলা করে, আইন দেখাতে গিয়েছেন তো আপনি শেষ। শিল্প কারখানা চালানো তো দূরের কথা নিজের মূলধন রক্ষা করা কঠিন।
তিতাসের এমনি গ্যাড়াকলে পড়ে অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ রোষানলে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছেন। এমনি এক ভুক্তভোগী গ্রাহকের নাম আয়মান টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারী লিমিটেড। তিতাসের (১৯৯২ সাল থেকে) ওই শিল্প গ্রাহকের ঘটনা কল্প কাহিনীকেও হার মানায়।
কোম্পানিটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম সরকার বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ঘটনার সূত্রপাত ২০১৫ সালের দিকে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়া ঠিকমতো বয়লার ও জেনারেটর চালানো যাচ্ছিল না। কোম্পানির পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও তিতাস কোন প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়নি। ওই সময়ে কোম্পানির কারখানা ঠিক মতো চালাতে ব্যর্থ হয়। এতে করে বায়ারকে ঠিকমতো অর্ডার সাপ্লাই দিতে না পেরে রুগ্ন হয়ে পড়ে। এ কারণে গ্যাস বিল বকেয়ার কারণে ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
আমরা যখন কিস্তি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেই তখন তারা এতে সাড়া দেয়নি। কয়েক দফায় আবেদন দিলেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তিতাস ১২ শতাংশ সারচার্জসহ (বিলম্ব মাশুল) ৬ কোটি ৪১ লাখ একবারে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আমরা বাধ্য হয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হই। হাইকোর্ট ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর একটি আদেশ জারি করে, এতে প্রথম কিস্তিতে ১ কোটি টাকা ও অবশিষ্ট বকেয়া প্রতিমাসের বিলের সঙ্গে ২০ লাখ টাকার কিস্তিতে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। আমরা পরদিনেই টাকা দেওয়ার জন্য তিতাসের কাছে গেলে তারা গ্রহণ করেনি। উল্টো তারা আপিল করে, সেখানে প্রায় বছরখানেক বিষয়টি পড়ে থাকে। পরে আপিল বিভাগ প্রথম কিস্তি ১ কোটি টাকা অপরিবর্তিত রেখে মাসিক কিস্তির অংক ৪০ লাখ টাকা করে দেয়।
এবার কোর্টের মাধ্যমে এক কোটি টাকা জমা দেওয়ার উদ্যোগ নিলে তারা উল্টো গিয়ে রিভিউ আবেদন করে। শেষে রিভিউয়েও হেরে যায় তিতাস। ১ কোটি টাকা জমা দিয়ে ২ মাস আগে সংযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার দেখেন তাদের নতুন হয়রানি।
মাসিক বিলের সঙ্গে প্রথম মাসে ২৮ লাখ ৩১ হাজার ২৬৬ টাকা ও দ্বিতীয় মাসে ২৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা ৩৭ টাকা সারচার্জ দাবি করে। বিল অনাদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও হুমকি দেয়। আমরা তিতাসের এমডি বরাবর চিঠি দিয়ে সারচার্জের কারণ জানতে চাই। কোন সদুত্তোর পাইনি। বাধ্য হয়ে লিখিত চিঠি দিলেও তারা কোন জবাব দেয়নি। এরপর তিন দিনের সময় দিয়ে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। সেই নোটিশেরও কোন জবাব দেয়নি। মৌখিকভাবে জানতে পেরেছি ওই ৫২ লাখ টাকা হচ্ছে বকেয়া বিলের সারচার্জ। অথচ বকেয়া ৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা সারচার্জসহ এসেছে। সারচার্জের ওপর সারচার্জ হয় নাকি। হাইকোর্ট টাকার অংক চূড়ান্ত করে দিয়েছে। সেই অর্ডারও মানতে চায় না তিতাস।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র গ্রাহককে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে কাজটি করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে টাকা নিয়ে ঘুরছে। তারা কেনো নিতে চায় না, তাদের উদ্দেশ্য কি। আর সাড়ে ৩ বছর ব্যবসা বন্ধ থাকায় বিনিয়োগের কি অবস্থা হতে পারে একবারও কি ভেবেছে তারা। কতগুলো লোক বেকার হয়ে গেছে। মালিক যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে, ব্যাংক কি তাকে ছাড় দেবে। কয়েক’শ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের দায় কে নেবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বলতে চাই না, আমার মনে হয় তিতাসের লোকজন কোন কারণে কোম্পানির উপর নাখোশ। তিতাস গ্যাস একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, তাদের সেবার মান উন্নয়ন করা উচিত। গ্রাহকদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
আয়মান টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাহাউদ্দিন মাহমুদ ইউসুফ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমরা সঙ্গে যা হয়েছে, বলার ভাষা নেই। আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কোর্টের মীমাংসিত বিষয়ে আবার প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছে।
একজন শিল্প গ্রাহক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তার মিটারে সমস্যা দেখা দিলে তিতাস গ্যাসকে অবহিত করেন। একাধিক দফায় যোগাযোগ করার পর ২ মাস পরে তারা এসে মিটার খুলে নিয়ে যান। আর সেই মিটার পরীক্ষা করতে সময় নেন আর ৬ মাস। তাহলে বুঝতে পারছেন তাদের সেবার নমুনা।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া বর্তমান এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহ যোগদানের পর থেকে কোম্পানির সেবার মান শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন চলছে ঘুষের স্বর্গরাজ্য। প্রি-পেইড মিটার খোলা বাজারে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও তিতাস প্রত্যেকটি মিটার কিনেছে ২৩ হাজার টাকা দিয়ে। কয়েক লাখ মিটার কিনতে তিতাস গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটি এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি অভিনব ও কল্পনাতীত। বৈধ সংযোগ বন্ধ, তখন সংযোগ দেওয়া হয়েছে, আবার সেসব গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি করার জন্য ভুয়া কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয়। ভুয়া ওই গ্রাহকরা যথারীতি পে-স্লিপের মাধ্যমে ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা জমা করেন। তিতাসের আবাসিক গ্রাহকেরা যেসব ব্যাংকে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল জমা দেন, সেই ব্যাংকগুলো থেকে ওই বাড়তি টাকার হিসাব কোম্পানির কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে আসে। কিন্তু এই টাকা তিতাসের হিসাবে জমা দিতে না পেরে (পোস্টিং না হওয়া) বেকায়দায় পড়ে তিতাস।
আরেকটি অভিনব ঘটনা ঘটে, গভীর রাতে সার্ভারে ঢুকে অবৈধ গ্রাহককে বৈধ করার। রাতের আধারে কোম্পানির সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করার দায়ে ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী ধরা পড়ে। আবার এমন ঘটনা ঘটেছে গ্রাহকরা বিল জমা দিয়েছেন কিন্তু সেই বিল জমা হয়নি লেজারে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রাহকদের এসব টাকা মেরে দিয়েছেন।
সম্প্রতি আরেকটি হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন হারুনুর রশীদ মোল্লাহ। বাহবা নেওয়ার জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবর বিজ্ঞপ্তি পাঠায় মিডিয়াতে। গত ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসী দাবি করেছেন তাদের এলাকার কখনও লাইন ছিল না। তাহলে কাটলো কিভাবে। এই ঘটনায় বেশ হাস্যকর ঘটনার জন্ম দেয়।
রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানিটির দুর্নীতির বিষয়ে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) সার্বিক অনুসন্ধান পরিচালনা করে। দুদকের এপ্রিলে প্রকাশিত ওই রিপোর্টে তিতাসের দুর্নীতির ২২টি খাত চিহ্নিত করে, ১২ দফা সুপারিশ প্রদান করে। তারপরও থেমে নেই দুর্নীতি। সবকিছু জানার পরও রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহকে একাধিক দফায় ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।