তথ্য সরবরাহের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে।
যেকোনো সংবাদকর্মী অফিস চলাকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ ও বক্তব্য গ্রহণ করতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে দেশের জনসাধারণের কাছে প্রদানযোগ্য সব তথ্য প্রদানের জন্য বদ্ধপরিকর। সে আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বর্ণিত পদ্ধতিতে তথ্য সরবরাহ ও তার ব্যাখ্যা প্রদান করছে।
১৫ মে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে এ তথ্য জানায় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অবাধ তথ্যপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সংরক্ষিত সব প্রকাশযোগ্য অর্থনৈতিক তথ্য ও উপাত্ত ওয়েবসাইটে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছে। কোনো বিশেষ প্রয়োজনে কোনো নির্দিষ্ট কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রবেশ পাস সংগ্রহ করে উক্ত কর্মকর্তার কাছে সংবাদকর্মীরা প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাও নিতে পারেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে প্রেস কনফারেন্স, প্রেস রিলিজ ও অন্যান্য মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করছে। সম্প্রতি, লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে সংবাদকর্মীদের প্রবেশ ও তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে।
ব্যাংক থেকে জানানো হয়, বিষয়টি স্পষ্টীকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কিত সংবাদমাধ্যমে প্রদানযোগ্য তথ্য প্রদান, তার ব্যাখ্যা ও সম্পূরক তথ্যাদি দেওয়ার জন্য নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা মুখপাত্র এবং পরিচালক পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা সহকারী মুখপাত্র হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সাংবাদিকদের জন্য সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করলে সাংবাদিকরা তথ্যপ্রাপ্তির সুব্যবস্থা সম্পর্কে আশ্বস্ত হতে পারতেন। তবে জরুরি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে অ্যাক্রিডিয়েটেড ও ব্যাংকের অনুমোদিত সাংবাদিকদের জন্য আলাদা অনলাইন পোর্টালে প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা করলেও সাংবাদিকেরা দেশের অর্থনীতির আসল চিত্র জনগণ ও সরকারের কাছে তুলে ধরায় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
এ বিষয়ে বেসরকারিখাতের এক ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, প্রবেশাধিকার সীমিত করেছে।
তিনি বলেন,সাংবাদিকেরা চাইলে যে কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নিয়ে তার কাছে যেতেই পারেন।
সবদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশের অধিকারে সীমাবদ্ধতা থাকে জানিয়ে সাংবাদিকবান্ধব এ ব্যাংকার সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিকদের দাবি হলো, অবাধ প্রবেশ। এটি একেবারেই আবেগবশত দাবি তাদের।
সাংবাদিকেরা যখন-তখন যে ব্যাংকের রুমে রুমে যাবেন, এটা ঠিক নয়। আবার আমি এটাও বলবো যে, দেশের স্বার্থে যেসব তথ্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা যেন সাংবাদিকরা পান, সেটিও বাংলাদেশ ব্যাংককে নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আমার মনে হয়, এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি বা কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, সাংবাদিকেরা ইচ্ছামতো বাংলাদেশ ব্যাংকে ঘোরাফেরা করতে চান। এটি একদমই ঠিক নয়। নিয়মিত তথ্য পেলে সাংবাদিকদের তো বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন-তখন প্রবেশের প্রয়োজন নেই। সাংবাদিকদের হাতে তো এত সময়ও নেই।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, প্রথম কথা হলো, আমাদের তথ্য অধিকার আইনে মূল চেতনা ‘তথ্য’কে অবারিত করা। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও আছে।
দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে তথ্য জানতে চান, তা ব্যক্তিগত তথ্য নয়, যা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন। সাংবাদিকেরা যা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যান, তার সবই সাধারণ মানুষের তথ্য চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে চাওয়া। এ ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন ও হুইসেল ব্লোয়ার আইনে এ অধিকার দেওয়া আছে। আবার ওই একই আইনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য ‘সংবেদনশীল’ হিসেবে গোপনীয় রাখার বাধ্যবাধকতা আছে, তাও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক এই সভাপতি বলেন, তথ্য না দিলে গুজব সৃষ্টি হয়, সেটিও বিপজ্জনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘নিজস্ব তথ্য ব্যবস্থাপনা’ থাকা উচিত। প্রবেশাধিকার সংকুচিত করে তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করা আদর্শ পথ নয়।
তিনি বলেন, তিনটি উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারে। এর একটি হলো, ‘তাৎক্ষণিক’ এবং ‘অনলাইন বা ওয়েবসাইট’। দ্বিতীয়টি হলো- ‘নিয়মিত ব্রিফিং’ এবং সেইসঙ্গে তৃতীয়টি হলো- ‘জরুরি সংবাদ সম্মেলন’। ‘ব্রিফিং’ আর ‘সংবাদ সম্মেলন’-এর পার্থক্য হলো একটি, একতরফা আর অন্যটি ইন্টারঅ্যাকটিভ (পারস্পরিক যোগাযোগ)।
কোনো সাংবাদিক ব্যাংকের নির্দিষ্ট কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে অনুমতি চাইলে এবং সেটি যদি পেয়ে যান, তাহলে তা রুদ্ধ করা যাবে না। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা সাংবাদিককে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া বা না-দেওয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনো কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ থাকা উচিত নয়।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার সাংবাদিকদের বলেন, সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নিয়মের মধ্যে তথ্য শেয়ার করে। রুমে রুমে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা ঠিক নয়। আমাদের সবাইকে নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব তথ্য স্পর্শকাতর নয়, তা দেশের স্বার্থে জনগণকে অবহিত করা উচিত হবে।
সম্প্রতি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের অফিস কক্ষে প্রবেশের অধিকার চেয়ে সাংবাদিকদের দাবি, একেবারে ‘ইমোশনাল’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নমুনা গবেষণা নিয়ে ‘লাল-নীল’ সূচক সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের সূত্র ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম প্রধান ‘কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন’। আর দশটি এ ধরনের স্পর্শকাতর স্থাপনার মতোই এর নিরাপত্তা অত্যন্ত সুরক্ষিত থাকা প্রয়োজন। এসব তথ্য দেশের অর্থনীতির জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষকে জানানোর ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যমই সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে।
তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এটি একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানও বটে। এর সুনির্দিষ্ট দায়িত্বও রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে অনেক তথ্য এবং ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরির পর এ ‘সুরক্ষা’র বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। এবার যে নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, সেটি শুধু সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে হলে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এ প্রসঙ্গে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদক ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, আমি মনে করি, একটা পয়েন্টে গিয়ে আমাদের থামতে হবে। সবাইকে ছাড় দিয়েই একটা বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে। আমরা পেশাদার সাংবাদিক আর তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকার।
আমাদের উভয়ের দায়িত্ব হলো, দেশ ও জাতির স্বার্থে নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। কোনো পক্ষই যেন সৃষ্ট বিষয়গুলো ‘ইগো’ হিসেবে না নেয়।
শামসুল হক জাহিদ বলেন, আত্মসমালোচনা করে আমি বলতে পারি যে, আমরা ব্যাংক বিটের সাংবাদিকরা সবাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘রুলস অব বিজনেস’ ও বিশেষায়িত কোর অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখি না।
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ন্যূনতম ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি (আর্থিক বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান) নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব কক্ষে সব ফাইলেই সাংবাদিকদের ‘অ্যাকসেস’ থাকতেই হবে, এটা ঠিক নয়। এতটা অবারিত সুযোগ থাকা উচিতও নয়।
আমাদের সময়ে আমরাও অনেক কর্মকর্তার কক্ষে যেতাম। সামনেই ফাইলের স্তূপ থাকতো। আমাদের বলে দিতেন, এটা দেখতে পারবেন। (আরেকটা দেখিয়ে) ওটা নয়। এইটুকু সীমাবদ্ধতা দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, তথ্যপ্রবাহের সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক অবরুদ্ধ করে দেবে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন বলেন, প্রবেশাধিকার যতটুকুই দেওয়া হোক না কেন, তা যেন মর্যাদাপূর্ণ হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। নিরাপত্তারক্ষী থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত যেন সবাই সাংবাদিকদের দেওয়া অধিকারটুকুর প্রতি মর্যাদাশীল আচরণ করেন।