ইরান থেকে গোপনে এলপিজি আমদানি করা হচ্ছে!
বাংলাদেশের কিছু প্রতিষ্ঠান গোপনে ইরান থেকে এলপিজি আমদানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইরানের এলপিজি আমদানি করে প্রথমে ইরাকে, তারপর ইরাকি বন্দর থেকে পণ্য লোড দেখিয়ে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
ইরানের এলপিজির তথ্য গোপন করে ভুয়া ডকুমেন্ট প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে একজন এলপিজি আমদানিকারক দাবি করেছেন। এতে করে কম দামে আনা এলপিজির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না তারা।
তিনি আরও বলেছেন, একদিকে যেমন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তেমনি দেশেও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন একটি দেশ হওয়ায় এ ধরনের আমদানি বাংলাদেশকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। ফ্রেশ এলপিজি ও জেএমআই এলপিজিসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান
এই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে আগমনকারী 'জি-ওয়াইএমএম' নামের একটি জাহাজকে অবৈধ আমদানির কাজে ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, 'জি-ওয়াইএমএম' নামের যে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে আছে তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর (আইএমও নম্বর: ৯১৩৯৬৯৬) এবং 'জে টাইগার' নামে অন্য একটি জাহাজের রেজিস্ট্রেশন নম্বর একই। অনেকে ধারণা করছেন 'জে ওয়াইএমএম' নামের জাহাজটি একটি ভুয়া নাম ব্যবহার করে ইরানি এলপিজি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে।
গ্যাস চ্যালেঞ্জার নামে একটি কোম্পানি ইউসিবিএল ব্যাংকে এলসি খুলে ইরানি এলপিজি আমদানি করেছে। ইতোমধ্যে এলপিজি ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কয়েকটি ব্যাংকের এ জাতীয় অবৈধ ব্যবসায় সহায়তার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি অভিযোগ দাখিল করেছে। এতে দশটি কোম্পানি বিভিন্ন ভেসেল ব্যবহার করে ডকুমেন্টস জালিয়াতির মাধ্যমে এলপিজি আমদানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
কাস্টমস হাউস চিটাগাংয়ের বিল অব এন্ট্রি এবং ইমপোর্ট জেনারেল মেনুফেস্ট (আইজিএম) ডকুমেন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের একটি কোম্পানি 'জি ওয়াইএমএম' নামের জাহাজে ইরাক থেকে ২১ হাজার ১০০ মেট্রিক টন এলপিজি ইরাকের খর আল জুবায়ের বন্দর থেকে লোডিং দেখিয়ে আমদানি করেছে।
কিন্ত ইরাকের বসরা গ্যাস কোম্পানি বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা এক ইমেইলে জানিয়েছে যে তারাই একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত ইরাকি কোম্পানি যেটি কাসর পোর্টের মাধ্যমে এলপিজি রফতানি করে থাকে । কিন্তু তারা রফতানির জন্য 'জে ওয়াইএমএম' জাহাজে কোন এলপিজি লোড করেনি। এছাড়া তারা খর আল জুবায়ের বন্দর থেকেও রফতানির জন্য কোনো এলপিজি লোড করেনি। তারা আরও বলেছেন যে, ২০ হাজার ১০০ মেট্রিক টনের মত এতবড় এলপিজি জাহাজ লোড করার মত কাজ করেন না এবং এবছর করার কোন পরিকল্পনাও তাদের নাই। অথচ কাস্টমস ডকুমেন্টস বলছে এই জাহাজ ইরাক থেকে আসছে।
ইরান থেকে এলপিজি আমদানির বিষয়ে অভিযোগের তীর রয়েছে এম রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। যিনি এক সময় বিএম এনার্জির হেড অব সাপ্লাই চেইন ছিলেন।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি আমদানিকারক না, সে কারণে এর সঙ্গে যুক্ত থাকার কোন সুযোগ নেই। বিএম এনার্জির সাপ্লাই চেইনের হেড থাকায় কিছু যোগাযোগ তৈরি হয়। আমি আসলে সেলার ও বায়ারের মধ্যে যোগাযোগ করে দেই। তারা কে কোথা থেকে এলপিজি আনে সেটা তাদের বিষয়। আমি ইরানের কোন কোম্পানির সঙ্গে কখনও আলোচনা করি না। তবে ওমান এবং ইরাকের কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আমার। ওমান ও ইরাকের চেম্বারে যথাযথ কাগজপত্রসহ আনা হয়।
তিনি বলেন, আগেও একবার ইরান থেকে এলপিজি আমদানির অভিযোগ উঠেছিল, পরে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ইরান থেকে এলপিজি আমদানি হয় কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইরে কেউ আনে কি-না আমার জানা নেই। আমার মনে হয় বাজারে যখন একটা কথা আসে, সেটার কিছুটা সত্যতা থাকতে পারে। আমি যখন চাকরি করতাম তখন লোয়াবের (এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন) মিটিংয়ে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে শুনেছি।
অভিযোগ রয়েছে এক ব্যক্তি বিভিন্ন কোম্পানির ব্যানারে বাংলাদেশে ইরানি এলপিজি সরবরাহ করছে। কিন্তু এইসব কোম্পানির মালিকগণ একই ব্যক্তি। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে মানাসি ট্রেডিং এলএলসি, সাহেল স্টার ওয়েল এন্ড গ্যাস এলসিস, মেরানো পেট্রোকেমিক্যাল এলসিসিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির নাম।
এলপিজি ব্যবসায়ীরা অনেকেই মনে করেন, ইরান থেকে গোপনে এলপিজি আমদানি হলে তা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তৈরি করবে। তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। তারা আরও বলেছে, ইরান থেকে আমদানি করা এলপিজি মানের দিক থেকে নিম্নমানের এতে গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের এলপিজির বাজার দ্রুত বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন। দেশে ব্যবহৃত এলপিজির সাড়ে ৯৮ ভাগ আমদানি নির্ভর। সরকারি (বাংলাদেশ এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) কোম্পানির মার্কেট শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশের মতো। সরকার এখন পর্যন্ত ৫৬টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২৮টির মতো কোম্পানি মার্কেটে রয়েছে, বেশকিছু কোম্পানি প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে।