চট্টগ্রামে এইচএসসির ফলে ‘বন্যার ক্ষত’

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সড়ক কিংবা বাড়ি- সবখানেই ছিল কোমরসমান পানি। ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না খাবার পানি। খাওয়াদাওয়া ও ঘুমানোর সুযোগটাও ঠিকমতো মেলেনি। সেখানে পড়াশোনার পরিবেশ কোথায়? গত আগস্ট মাসের শুরুতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় টানা চারদিন ধরে বৃহত্তর চট্টগ্রামের অনেক জেলা ও উপজেলায় ছিল এই চিত্র।

সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চট্রগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১০ দিন পেছানো হয়েছিল। পরিবর্তিত সময়সূচি অনুযায়ী এই তিন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা ১৭ আগস্টের পরিবর্তে ২৭ আগস্ট থেকে শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে পরীক্ষা পেছানো হলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বইপত্র নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ভালো করে এসব অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারেননি। সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মনের ওপরও বড় একটা ব্যাঘাত তৈরি করেছিল বন্যা। এসবের প্রভাব পরীক্ষায় পড়েছে বলে মনে করছেন অভিভাবক আর শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা।

রোববার (২৬ নভেম্বর) প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রামে এবার গত তিন বছরের তুলনায় পাসের হার ও ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫, উভয়টি কমেছে। আগের বছর যেখানে ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিলেন সেখানে এবার ৬.০৫ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ এবার পাস করেছেন ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তো নেমে এসেছে অর্ধেকে। আগের বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন পরীক্ষার্থী, সেখানে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৩৯ জন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের ওই বন্যায় চট্টগ্রামে ২৮ হাজার ৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরমধ্যে ১৮ হাজার ৮৮৫ ঘরবাড়ি আংশিক ও ৯ হাজার ১৮৫ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলায়। সাতকানিয়ায় দুই হাজার ৪৭৯টি ঘর আংশিক ও নয় হাজার ১৮৫টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। চন্দনাইশে চার হাজার ১২০টি ঘর আংশিক ও ৬ হাজার ৩৭৯টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লোহাগাড়ায় ২৫০০ ঘর আংশিক ও দুই হাজার ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। বন্যায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বান্দরবান জেলা। পার্বত্য এই জেলায় বন্যায় ১০ হাজার ৬৬০টি বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এসব জেলা ও উপজেলার কলেজগুলো পড়েছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে।

এসব এলাকার শিক্ষার্থীদের ওপর যে বন্যা প্রভাব ফেলেছে সেটি বোঝা যাবে একটি পরিসংখ্যান দিলে। মহানগরী বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় এবার পাসের হার ৬৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ। অন্যদিকে বান্দরবানে এবার পাসের হার মাত্র ৬৬ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি, ৮১ দশমিক ২০ শতাংশ।

বন্যার সময় ঘরবাড়ি পানিবন্দী থাকা, বিদ্যুৎ না থাকা এবং বইপত্র নষ্ট হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। শিক্ষক আর অভিভাবকেরও ছিলেন দুশ্চিন্তায়। শুধু তাই নয়, বন্যার কারণে বান্দরবানে ট্রেজারি অফিসও দুদিন পানিবন্দী ছিল। এ কারণে ৮০ শতাংশ প্রশ্নই নষ্ট হয়ে যায়। পরীক্ষা পেছানোর কারণে দ্রুত অন্যান্য জায়গা থেকে প্রশ্নপত্র সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বন্যা যে প্রভাব ফেলেছে তা মেনে নিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র নাথ ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান।

বোর্ডের সচিব নারায়ন চন্দ্র নাথ বার্তা২৪.কমকে বলেন, বন্যায় চট্টগ্রাম জেলার একাংশ ও বান্দরবান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা জানতে পারি ঘরে পানি ঢোকায় অনেক শিক্ষার্থীকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকতে হয়েছে। তাদের বই পত্রসহ জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়। সেজন্য শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছিল, পরীক্ষা পেছাতে। আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানাই। পরে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরীক্ষা ১০ দিন পেছানো হয়। এতে যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি সেসব এলাকার শিক্ষার্থীরা লাভবান হয়েছে। তবে যেহেতু বইপত্র নষ্ট হয়ে যায়, সে কারণে পরীক্ষা পেছানোর সুবিধাটা হয়তো তেমন একটা নিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা।

প্রায় একই কথা বলেছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এম এম মুজিবুর রহমান। তবে শুধু বন্যার কারণেই যে ফল ধস হয়েছে সেটি মানতে চাননি তিনি। বলেন, শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতার কারণেও ফল খারাপ হতে পারে। পাশাপাশি আগের তিন বছরে করোনার কারণে এক বছর পরীক্ষা হয়নি, আবার শেষ দুই বছরেও পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা হয়নি। এ কারণে আগের বছরগুলোতে ফল ভালো হয়েছিল। এবার পরিপূর্ণ সিলেবাসে সবগুলো পরীক্ষা হয়েছে। সেদিকে হিসাব করলে ২০১৯ সালের পরীক্ষার তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে।