উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভুলের পরিমাণ বেড়েই চলেছে

  • রেদওয়ান আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেট, বার্তা ২৪.কম, চট্টগ্রাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তরপত্রের নম্বর গণনা ও নম্বর বসানোতে ভুলের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এবারও উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে ৮৮৭ পরীক্ষার্থীর নম্বর। যার সুযোগ নিয়ে ফেল থেকে পাস করেছেন ১৫২ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন করে ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৯ জন।

শুধু এই বছর নয়, প্রতিবছরই এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। পরীক্ষকদের গাফিলতির কারণেই মূলত এমন ভুলের শিকার হচ্ছেন পরীক্ষার্থীরা। এর ফলে শুরুতে অনেক শিক্ষার্থীর ফল অকৃতকার্য চলে আসে। কিন্তু পুনর্নিরীক্ষণের পর দেখা যায়, আসলে তাদের অনেকেই পাস করেছিলেন। কিন্তু ওই সব শিক্ষার্থীকে পুনর্নিরীক্ষণের ফল বের হওয়া পর্যন্ত নানা উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও মানসিক যন্ত্রণায় সময় কাটাতে হয়। এমনকি কখনো বা পারিবারিক, সামাজিক ও বন্ধুবান্ধবদের থেকে আসা এই চাপ ও লজ্জা না সামলাতে পেরে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন কেউ কেউ।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, উত্তরপত্র মূল্যায়নে তিন ধরনের ভুল করছেন পরীক্ষকেরা। তারা কিছু উত্তরপত্রে নম্বরের যোগফল ভুল করেছেন। আবার কিছু উত্তরের নম্বর যোগ করেননি। এর বাইরে ওএমআর (বহুনির্বাচনী উত্তরপত্র) ফরমে বৃত্ত ভরাটেও ভুল করেছেন কেউ কেউ। উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণ করতে গিয়ে ভুলগুলো ধরা পড়ে। এরপর সংশোধন করা হয়।

আগের বছরগুলোতেও একই চিত্র:

২০২২ সালে এই বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণে ৭৭৭টি উত্তরপত্রের নম্বর পরিবর্তন হয়। নতুন করে ফেল থেকে পাস করেছিলেন ৭৬ জন। তবে, সে বছর নতুন করে জিপিএ-৫ পাননি কেউই। ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায়ও পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ নিয়ে ফেল থেকে পাস করেন ২৭ জন শিক্ষার্থী। পাশাপাশি নতুন করে জিপিএ-৫ পান ছয়জন শিক্ষার্থী। সে বছর সবমিলিয়ে ৫৯ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়। তবে মহামারী করোনার কারণে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সে বছর শিক্ষার্থীদের আগের দুই পরীক্ষার (জেএসসি ও এসএসসি) ফল বিবেচনায় অটোপাস দেওয়া হয়। সে কারণে সে বছর পুনর্নিরীক্ষণের প্রয়োজন হয়নি।

এর আগের বছরও পুনর্নিরীক্ষণের পর বড় ধরনের ফল পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। সে বছর পুনর্নিরীক্ষণে পাস করেছিলেন ৪৭ জন এবং নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৪ জন। সব মিলিয়ে গ্রেড পরিবর্তন হয়েছিল ২৯৭ জন শিক্ষার্থীর। একইভাবে ২০১৮ সালে পুনর্নিরীক্ষণের পর ফল পরিবর্তন হয়েছিল ৪০৯ জন শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছিলেন ৫৪ জন। সে বছর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২০ জন। ২০১৭ সালেও ফেল থেকে পাস করেছিলেন ৫০ জন শিক্ষার্থী, নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৩ জন। গ্রেড পরিবর্তন হয়েছিল ৮৬ শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে প্রতিবছরই প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী পুনর্নিরীক্ষণের পর পাস করছেন, অনেকেই পাচ্ছেন জিপিএ-৫।

উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজে অবহেলা ও অমার্জনীয় ভুলের জন্য প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষককে শাস্তি দেয় শিক্ষাবোর্ড। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সামনের বছরগুলোতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন থেকে বিরতি রাখা হয়। তবে পরীক্ষকের সংকটের কারণে শিক্ষাবোর্ড চাইলেও তাদের কঠোর শাস্তি আরোপ করতে পারে না। ফলে ’গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ হওয়ায় পরীক্ষকেরাও তেমন একটা সাবধান হন না।

তবে খাতা মূল্যায়নে পর্যাপ্ত সময় না থাকায় এমন ভুল হয়েছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এ এম এম মুজিবুর রহমান। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অন্যান্য শিক্ষাবোর্ড থেকে আমাদের বোর্ডে এবার দেরিতে পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু ফলাফল ঘোষণা করতে হয়েছে একইদিনে। অল্প সময়ের মধ্যে খাতা কাটার কারণে কিছু ভুলত্রুটি রয়ে যায়। তবে যারা ফেল থেকে পাশ করেছেন, তারা কিন্তু বিশাল পার্থক্যে ফেল থেকে পাস করছেন এমন না। মাত্র দু-এক মার্কের হেরফের। আর সংশোধনের জন্যই কিন্তু আমরা পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ রেখেছি। যাতে ফল নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকলে, সে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করতে পারে।’

মাত্র দু-এক মার্কের কারণে পুনর্নিরীক্ষণের আগে ফেল করা শিক্ষার্থীরা নানা উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও মানসিক যন্ত্রণায় থাকেন, এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নেন-এর দায় আপনাদের আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এ এম এম মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এসবের তো একটা দায় আছেই। তবে আমরা ভুল থেকে যতটুকু সম্ভব উত্তরণের চেষ্টা করছি। গত কয়েক বছর ধরে এই ভুলের হার বাড়ছে কেন এমন প্রশ্নের জবাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, পরীক্ষাটা একটা চাপ। শিক্ষার্থীদের জন্য এবং যারা অল্প সময়ের মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়নের চেষ্টা করেন, তাদের জন্যও। সেই চাপের কারণে কিছু ভুল হয়েছে।’

বন্যা পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডসহ তিন বোর্ডের পরীক্ষা ১০দিন পরে শুরু হয়েছিল। এ কারণে খাতা মূল্যায়নের জন্য এবার এই তিন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষকেরা ১ মাস ২০দিন মতো সময় পেয়েছেন। তবে এই সময়কে যথেষ্ট মনে করেন না চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। তিনি বলেন, এই সময়টা খাতা মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় নয়। খাতা মূল্যায়নের জন্য আরও বেশি সময়ের প্রয়োজন ।

উল্লেখ্য গত ২৬ নভেম্বর সারাদেশে একযোগে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অবশ্য পুনর্নিরীক্ষণের পর সেই হার তেমন একটা বাড়েনি। আর নতুন করে জিপিএ-৫ পাওয়া ৭৯ জন শিক্ষার্থীসহ এই বছর জিপিএ-৫ পেলেন ৬ হাজার ৪১৮ জন।