বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়: শিক্ষার্থী ৮২ জন, শিক্ষক শূন্য
চট্টগ্রামের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের বদলে দেওয়ার ঠিকানা বলা হয়ে থাকে-চট্টগ্রাম সরকারি বাক-শ্রবণ বিদ্যালয় এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়কে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের ছোঁয়ায় অনেক শিশুই নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই ফিরে এসেছে সমাজের মূলধারায়।
কিন্তু বাক-শ্রবণ বিদ্যালয়টি আজ যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। চার বছর ধরে কোনো শিক্ষকই নেই এই বিদ্যালয়টিতে। ফলে-আগামীতে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা কোথায় পাবে জীবনের দিশা, সেই প্রশ্নই সামনে আসছে।
চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরের অদূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি বাক-শ্রবণ বিদ্যালয় ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ফিজিক্যাল হ্যান্ডিক্রাফ্ট ট্রেনিং (পি.এইচ.টি.) সেন্টার নামে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত এই দুই বিদ্যালয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা কম খরছে পড়াশোনার সুবিধা পায়। কিন্তু বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়টিতে কোনো শিক্ষক না থাকায় এখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের একজন ধর্মীয় শিক্ষক দিয়ে কোনোরকমে চলছে পাঠদান। যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাহত হচ্ছে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পড়ালেখা।
পিএইচটি সেন্টার, চট্টগ্রাম অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, চট্টগ্রাম সরকারি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে মোট ১০৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বছরের শুরুতে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন আরও ১০-১২জন। এর মধ্যে আবাসিক ও অনাবাসিক মিলিয়ে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে রয়েছে ৮২ জন এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে রয়েছে ২৫ জন। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ৩ জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে নেই একজন শিক্ষকও। তবে, বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষকের অনুমোদন রয়েছে। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে রয়েছে ১০ জন শিক্ষকের অনুমোদন।
এই শিক্ষক শূন্যতার কারণে বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা থেকে। কেননা, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে গত প্রায় চার বছর ধরে কোনো শিক্ষক না থাকার কারণে ব্যাহত হচ্ছে তাদের পড়ালেখা। যদিও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগের ওই শিক্ষক মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কোনোরকম চালিয়ে নিচ্ছেন পাঠদান কার্যক্রম।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগের ধর্মীয় শিক্ষক মনছুরুল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, এই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ রয়েছে। এরপর সাধারণ স্কুলে ভর্তি হতে হয়। মূলত চট্টগ্রামে এই বিদ্যালয়টি দুটি প্রতিবন্ধী শিশু কিশোরদের মধ্যে পড়ালেখার ভিত তৈরি করে দেয়। তবে, বর্তমানে কিছু সংকট রয়েছে এখানে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় শিক্ষক সংকট। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিভাগে ৩জন শিক্ষক থাকলেও বাক-শ্রবণে একজন শিক্ষকও নেই। যার কারণে বাধ্য হয়ে আমাকে অ্যাপের সাহায্যে ক্লাস নিতে হচ্ছে। কিন্তু ওদের পড়ানো আমার পক্ষে কঠিন। কেননা, তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক লাগে।
এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার বিষয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। শিক্ষক নেই, স্থায়ী শ্রেণিকক্ষ নেই, পর্যাপ্ত আবাসন নেই। তাদের এই দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। যার কারণে, অভিভাবকেরা তাদের এই বাক-শ্রবণ প্রতিবন্ধী সন্তানদের ভবিষ্যৎ পড়াশোনার চিন্তায় খুবই উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায় অভিভাবকদের দাবি, বিদ্যালয়ে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।
পিএইচটি সেন্টার, চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ও স্কুলটির তত্ত্বাবধায়ক কামরুল পাশা ভূঁইয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন, প্রায় চার বছর ধরে স্কুলটিতে কোনো শিক্ষক নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরে আমরা শিক্ষক নিয়োগ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এখনো কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। শিক্ষক না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তারা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হওয়ায় তাদের যেকোনো শিক্ষক দিয়ে পাঠদান দেওয়া সম্ভব হয় না। তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। অতিসত্বর তাদের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া না হলে তারা অনেক পিছিয়ে পড়বে।
প্রতিষ্ঠান দুটিতে কবে নাগাদ শিক্ষক নিয়োগ হতে পারে জিজ্ঞেস করলে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, প্রতিষ্ঠান দুটিতে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। জেলা প্রশাসক মহোদয়ও নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছেন ওই সেন্টার সম্পর্কে। আশা করি, খুব শিগগিরই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাদের উপযুক্ত শিক্ষক পাবেন।
এ বিষয়ে জানতে পিএইচটি সেন্টারের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও পাওয়া যায়নি।