‘জ্ঞাননির্ভরতা থেকে কখনো বেরিয়ে আসা যাবে না’
নতুন শিক্ষাক্রম যেভাবে সাজানো হয়েছে, সেটি ভালো। এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের শিক্ষা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার জন্য গলদঘর্ম হতে হবে না। তবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে। এ ছাড়া নতুন ব্যবস্থায় ব্যাকরণসহ আরও কিছু বিষয় যুক্ত করা দরকার।
রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে রবিবার (২৮ এপ্রিল) বিকালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ও নতুন শিক্ষাক্রম’ বিষয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এ বৈঠকের আয়োজন করে। এতে শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিশেষজ্ঞ, শিক্ষাক্রম প্রণয়নে যুক্ত ব্যক্তি, শিক্ষকনেতা ও অভিভাবকেরা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি।
কোনো কোনো মহল থেকে ওঠা নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনার জবাব দেন গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে অবশ্যই জ্ঞানের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। জ্ঞাননির্ভরতা থেকে কখনো বেরিয়ে আসা যাবে না। বিষয়টি (নতুন শিক্ষাক্রম) হচ্ছে জ্ঞানের সঙ্গে দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োগের জায়গাটি যেন থাকে।’
‘আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আজিজুর রহমান। তিনি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
আজিজুর রহমান নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে বলেন, শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষার চেয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনই সময়োচিত ও যথার্থ। তার আশা, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার জন্য গলদঘর্ম হতে হবে না বা কোচিং সেন্টারেও দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না।
নতুন শিক্ষাক্রমের কিছু নেতিবাচকও দিকও তুলে ধরেন অধ্যাপক আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, বিদ্যমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বহাল রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অসম্ভব। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে-বাইরে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা পাল্টাতে গিয়ে শিক্ষকদের কাজের চাপ অনেক বেড়ে যাবে, যা ৮০-৯০ শিক্ষার্থীর ক্লাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদাভাবে মনোযোগ দেওয়া একজন শিক্ষকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
রাজধানীর সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম তার কাছে বড় সংকট মনে হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেরুন নেসা গৃহশিক্ষকতা করেন। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে নতুন শিক্ষাক্রম সাজানো হয়েছে, সেটি ভালো।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি সুপরিকল্পিত কি না, এ প্রশ্ন রাখছি। বিক্ষিপ্তভাবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব আমরা লক্ষ্য করছি।’
বিক্ষিপ্তভাবে বাস্তবায়নের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন নুর মোহাম্মদ তালুকদার। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন বিষয়টি এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বলা হয়েছে, দুই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়ন বিষয়টি স্পর্শকাতর। চিন্তাভাবনা ও বিশদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ গোলটেবিলে উত্থাপিত আলোচনার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে বলেন, আলোচনায় মনে হয়েছে, বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এটি অনেকাংশেই বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, এটি বাস্তবায়নে যে পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষকের প্রস্তুতি, অবকাঠামো, উপকরণ ও অভিভাবকদের প্রস্তুতি দরকার, তাতে ঘাটতি আছে। সে জন্য সামগ্রিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। বাস্তবতার নিরিখে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
শিক্ষার জন্য শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য একক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, মনে হয়, দুই ভাগে ভাগ হয়ে সমন্বয়ে সমস্যা হয়েছে। তিনি স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান শিক্ষাক্রম নিয়ে গোলটেবিলে উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ের জবাব দেন। তিনি বলেন, এখন একেকটি শ্রেণি শাখায় ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এটি ধাপে ধাপে ৪০–এ আনা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান শিক্ষাক্রম নিয়ে উদ্বেগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। কারণ, এবার শিক্ষাক্রম সংস্কার নয়, একেবারে রূপান্তর হয়েছে। ফলে খাপ খাওয়াতেও চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। এগুলো ধাপে ধাপে খাপ খাওয়ানো যাবে।
কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে শিক্ষক নেতা মাহফুজা খানম, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব শরীফ আহমদ, শিক্ষক নেতা আকমল হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন।