প্রতিপাদ্যসার
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দেশত্যাগের মাধ্যমে সূচিত হয়। যে ঘটনায় ব্রিটিশদের কাছে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’ নামে পরিচিত হলেও নব্য-সৃষ্ট ভারত ও পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর, যাতে একই সাথে ভারত উপমহাদেশ এবং বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হয়। যে কারণে সাধারণভাবে ঘটনাটিকে ‘দেশভাগ’ নামেও চিহ্নিত করা হয়। এতে ক্ষমতা হস্তান্তর, দেশভাগ ও দুটি দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছাড়াও ১৪ থেকে ১৮ মিলিয়ন মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, যাকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দেশান্তরের বা গণঅভিবাসনের ঘটনা রূপে চিহ্নিত করা হয়, যে দেশত্যাগীদের অনেকেই জীবিত অবস্থায় নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতেপারেন নি। তাছাড়াও দেশভাগের আগে ও পরে সংঘটিত প্রবল সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামায় কমপক্ষে এক মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ২০২২ সালে ‘দেশভাগ’ নামক মর্মান্তিক ঘটনার ৭৫ বছর পূর্তি হয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, সহিংস রক্তপাত ও হিংসার জন্ম দিয়েছিল, তা ৭৫ বছর পরেও পুরোপুরি মুছে গিয়েছে কিনা, তা বর্তমান প্রবন্ধে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
চাবিশব্দ: দেশভাগ, ক্ষমতা হস্তান্তর, সাম্প্রদায়িকতা, অভিবাসন, উদ্বাস্তু, দাঙ্গা, জাতিগত বিদ্বেষ।
১.
বাংলার লোকসাহিত্য ভা-ারে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নামের মণিমুক্তা-তুল্য পালাগুলো সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। এসবের সিংহভাগই কিশোরগঞ্জের, কিছু পার্শ্ববতী নেত্রকোণার। ব্রিটিশ আমলের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের অংশভুক্ত হওয়ায় গ্রন্থের এরূপ নামকরণ। নিজস্বতার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের ভৌগোলিক সীমানা চারপাশ থেকে চার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জনপদকে আলিঙ্গন করেছে: উত্তরে গারো পাহাড়ের উপত্যকা, দক্ষিণে ঢাকা-ভাওয়ালের অরণ্য, পূর্বে চিরায়ত সিলেট-কামরূপ, পূর্ব-দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লার নদী অববাহিকা, আর পশ্চিমে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাদবাকী অংশ। ঘটনাক্রমে কিশোরগঞ্জ আমাব জন্মস্থান এবং পুরনো ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকার ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ জনপদটি আমার শৈশব-কৈশোরের ভিত্তিভূমি। আমার পরিবারের বংশানুক্রমিক আদিবাসও কিশোরগঞ্জেই। কিশোরগঞ্জ সীমান্তবর্তী অঞ্চল নয়, যেমনভাবে সীমান্ত-সংলগ্ন নয় এপারের বিক্রমপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি ও ওপারের বর্ধমান বা হুগলি। সীমান্তের জেলা চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর. কোচ বিহার ইত্যাদির মতো প্রত্যক্ষ আঁচড় বা ভৌগোলিক বিভাজন উভয় বঙ্গের সীমান্ত থেকে দূরবর্তী জেলা বা জনপদগুলোতে দৃশ্যমান হয় নি। কিন্তু দেশভাগের পরোক্ষ প্রভাবে সর্বত্রই জনবিন্যাস, সমাজ কাঠামো ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। ফলে দেশ, দেশভাগ, বিভাজন, মানবম-লী সংক্রান্ত আলোচনা বা পর্যবোষণ উপরতলার জাতীয় স্তরের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়কে আশ্রয় করে করারও অবকাশ রয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ৭৫ বছর পরেও দেশভাগের ক্ষত সমাজের শেকড় পর্যায়ের মানুষের মধ্যে কীভাবে ও কেমন ভাবে বিরাজমান, তা অনুভব করা সম্ভব হতে পারে।
ক) কিশোরগঞ্জ শহরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়কে পুরনো লোকজন ভূপেশ বাবুর বাড়ি বলে জানে। ভূপেশ গুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের কমিউনিস্ট নেতা। দেশভাগের আগেই তিনি কলকাতার বাসিন্দা। যেমনভাবে ইটনার আনন্দমোহন বসু, কটিয়াদীর উপেন্দ্র কিশোর রায় প্রমুখের বসতবাড়ি পড়ে আছে কিন্তু তাঁরা নেই। তাঁদের শূন্যতা দেশভাগের কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়। দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তু না হয়েও তাঁরা কেউই আর ফিরে আসেন নি। এমন পরিবার অনেক যারা দেশভাগের আগে এবং দেশভাগের কারণে জন্মভূমি ছেড়েছেন। কখনো কলকাতা বা ভারতের কোথায় কোথায় তেমন পরিবারগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন তাদের দেখা পেলে সেসব কথা ফিরে এসে সঘন আবেগের সঙ্গে বর্ণনা করেন এবং সমগ্র শহরে তা আলোচিত হয়।
খ) কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে খাজা নাজিমুদ্দীনের বাড়ি, শেরে বাংলা ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের বাড়িগুলোও হাত বদল হয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দেশভাগ কলকাতার এমন অসংখ্য বাড়ির বাসিন্দাদের প্রত্যাবর্তনের পথ রুদ্ধ করেছে।
গ) দেশভাগের তোড়ে শুধু বাঙালিরাই নয়, একদল বিহারি এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের কিশোরগঞ্জ শহরে। সাধারণত উদ্বাস্তুরা সীমান্তের আশেপাশেই বসতি গড়েন। যশোর-চব্বিশ পরগণা, নদীয়া-কুষ্টিয়া, মালদা-চাঁপাই নবাবগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী, উভয় দিনাজপুরে এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান। অপশন দিয়ে কিংবা সম্পত্তি অদলবদল করে উভয় অংশের উদ্বাস্তু বা দেশান্তরী মানুষেরা সীমান্তের কাছাকাছিই অবস্থান করেন। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে: ১. দেশের কাছাকাছি থাকা। ২. ঋাষা ও সংস্কৃতির নৈকট্যের মধ্যে থাকা। ৩. রাজধানী বা বড় শহরে আর্থিক বা অন্যবিধ কারণে জায়গা করতে না পারা। তাছাড়া স্থানান্তরিত লোকজন নতুন বসতি স্থাপন করেছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি এমন স্থানে। যে কারণে সীমান্ত-সংলগ্ন জেলাগুলোর মতোই শিল্পশহর খুলনা ও বগুড়া, রেলশহর ঈশ্বরদী, শান্তাহার, জয়পুরহাটে বাঙালি ও অবাঙালি উদ্বাস্তুর ভিড় বেশি। রেলের চাকরির সুবাদে বিহারিা সেসব জায়গাতেই সংখ্যায় অধিক। কিন্তু একদল বিহারি, পেশায় যারা ধুনকর, বাস্তুচ্যুৎ হয়ে কিশোরগঞ্জে বসতি স্থাপন করেন। শৈশব থেকেই আমরা তাদের অবাক চোখে দেখতাম ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণে। বর্তমানে অবশ্য এদের স্থানীয়দের চেয়ে আলাদা করা যায় না। তথাপি বিহারের পূর্ণিয়া বা মুঙ্গের থেকে কিছু কিছু আত্মীয় প্রতিবছরই তাদের দেখতে আসেন, তারাও পালা করে ভারতের বিহারের আদিভিটায় তাদের ভাষায় ‘জিয়ারত’ করতে যান। সেসব আসা-যাওয়া ও মিথস্কিয়ার সূত্র এতো দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বিভক্তি ও তিক্ততার পরেও ছিন্ন হয় নি।
অতএব, দেশভাগে কেবলমাত্র সীমান্তবর্তী জেলাগুলো বিভাজিত হলেও তা সমগ্র বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষকেই নানা মাত্রা ও পরিমাণে স্পর্শ করেছে এবং ভূগোলের বিভাজন মানুষের হৃদয় ও আবেগকে বিদীর্ণ করেছে। দেশভাগ মোটেও রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ভাগাভাগিতেই আচ্ছন্ন কিংবা সীমিত থাকে নি, তীব্রভাবে বিভক্ত ও বিভাজিত করেছে মানবম-লীর নানা প্রসঙ্গ ও প্রপঞ্জকেও। ৭৫ বছর পর সেই ফাঁক ও ফারাক বেড়েছে নাকি কমেছে, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা কী অনুচিত হবে? হয়ত রাজনৈতিক তর্কে এই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তথাপি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রশ্নটিকে আদৌ উপেক্ষা করা সম্ভব হয় কি? মানুষের ‘মানবিক মন’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অক্লান্ত ও বিরামহীন।
২.
অত্যল্প আকারে হলেও জন্মস্থানকে টেনে আনা এবং এর মাহাত্ম্য ও ভৌগোলিক গাম্ভীর্য বর্ণনার মূল কারণ এই যে, অবিভক্ত বৃহৎ বঙ্গদেশের সঙ্গে এর বহুমাত্রিক সম্পর্কের নিরিখে ‘দেশভাগ’ নামক বিষয়টিকে পর্যালোচনা করা। তাছাড়া দেশভাগের ফলে সৃষ্ট ফাঁক, ভেদ ও বিভেদ, ক্ষতগুলো এবং অর্জন ও বিসর্জনগুলো সম্পর্কে বিগত ৭৫ বছরের পরিসরকে সামনে রেখে একটি পর্যবেক্ষণ করা। যদিও দেশভাগকে বীক্ষণ করার নানা মাত্রা ও দৃষ্টিভঙ্গির অভাব নেই। নানা তাত্ত্বিক ও বিদ্যায়তনিক কাঠামোতে এসব প্রচেষ্টা কমবেশি সচল। এবং এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন সাহিত্যিকগণ, পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এবং সর্বশেষে, অতিসম্প্রতি ইতিাহাস ও সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখার অ্যাকাডেমিশিয়ানগণ। বলাবাহুল্য, দেশভাগ সংক্রান্ত যাবতীয় চর্চার কাজে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের পাঞ্জাব অঞ্চল যতটুকু অগ্রগামী ও তৎপর, পূর্ব সীমান্তের বাংলা ভাষাভাষীগণ ততটুকু নয়, যদিও উভয় প্রান্তই দেশভাগের আঘাতে রক্তাক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত।
ভারতের পশ্চিমাংশে উর্দু ভাষায় ১৯৪৭ সালের আগে ও অব্যবহিত পরেই দেশভাগ নিয়ে তীব্রভাবে লেখালেখি, চর্চা ও ডিসকোর্স নির্মাণ শুরু হয়, যার প্রভাব সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং নাটক, চলচ্চিত্রসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিটি অঙ্গনকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। দেশভাগ বা স্বাধীনতার আদিভোরেই ঔপনিবেশোত্তর সমাজে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার জনগণের সম্পদে পরিণত হওয়ার বদলে নানা স্বার্থগোষ্ঠীর কুক্ষিগত হওয়ার প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (জন্ম. ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১১, মৃত্যু. ২০ নভেম্বর ১৯৮৪) তাঁর ‘স্বাধীনতার সকাল: আগস্ট ১৯৪৭’ শিরোনামের কবিতায়:
“ইয়ে দাগ দাগ উজালা, ইয়ে শাব গাজিদা সাহার
উযো ইন্তিজার থা জিস কা, ইয়ে উয়ো সাহার তো নেহি।”
[এই ফ্যাকাশে আলো, অন্ধকারে-মোড়া এই সকাল
এর জন্য তো অপেক্ষায় ছিলাম না আমরা।]
বাংলা ভাষায় দেশভাগ বিষয়ক আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত আরো অনেক পরে এবং ধীর লয়ে। ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু জীবনের নানা যন্ত্রণা চিত্রিত হতে থাকে, সঙ্গে কিছু স্মৃতিকথা। বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আগত লেখকগণ নিজের মাটি তৈরির কাজটি সামলিয়ে আরো পরে কলম ধরেন। কলকাতার চলচ্চিত্রে মূর্ত হওয়া দেশভাগ বৃহত্তর দর্শকদের আলোড়িত করে এবং দেশভাগ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার পরিধি বৃদ্ধি পায়। কলকাতার উপান্তের এক বস্তিতে নীতা, গীতাদের রিফিউজি বাবা কিশোরগঞ্জের মাস্টার মশাইয়ের পরিবারকে আবর্তিত ঘটনা দেশভাগের ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াগুলোর উন্মোচনের মাধ্যমে স্পর্শ করে মানুষকে। সবাই তখন আশেপাশে তাকিয়ে এমন আরো শত-সহ¯্র উদ্বাস্তু পরিবারের সাক্ষাৎ পান এবং তাঁদের পরিবর্তিত আত্ম-পরিচিতির অন্তরালে জীবন-সংগ্রামের গভীর দিকগুলোকে অনুভব করেন। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনী থেকে ঋত্বিক ঘটক ‘মেঘে ঢাকা তারা’ চলচ্চিত্রে তেমনই শৈল্পিক প্রতিফলন ঘটিয়েছেন দেশান্তরী মানুষের চিরন্তণ আর্তিতে। বহু বছর পেরিয়ে দেশভাগের ফলে বিভাজিত মানবম-লীর আর্তি চাপা পড়লেও একেবারেই শেষ হয়ে যায় নি। নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচিতি, নতুন জীবনের হাতছানির মধ্যেও বুক-চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে ভেসে ঠিক চলে যায় পূর্ব-পুরুষের আদিভিটায়, যা হয়ত হাতছাড়া হয়ে পড়ে আছে বিভক্ত বাংলা বা পাঞ্জাব বা ভারতবর্ষের কোনো কোনো প্রান্তে ও উপান্তে।
৩.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমার কর্মক্ষেত্র শুধু বাংলার নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সর্বদক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের চট্টগ্রামে অবস্থিত। কিন্তু আমার জন্মস্থানের অবস্থান পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশের মোটামুটিভাবে মধ্যভাগে, যে এলাকা অবিভক্ত বৃহৎ বঙ্গদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি তথা সর্বক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিস্তারিত বিবরণ এড়িয়ে কয়েকজনের নাম করছি, বিচক্ষণ লোকের জন্য সামান্য ‘ইশারাই কাফি’ হবে: কবি চন্দ্রাবতী (ষোড়শ/সপ্তদশ শতাব্দী) মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ (১৫৩৬-১৫৯৯), আনন্দমোহন বসু (১৮৪৭-১৯০৬), উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫), নীরোদ সি, চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (১৯১৪-১৯৭৬), মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (১৮৮৯-১৯৭০), রেবতীমোহন বর্মণ (১৯০৩-১৯৫২), ড. নীহাররঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১), দেবব্রত বিশ্বাস (১৯১১-১৯৮০), ভূপেশ গুপ্ত (১৯১৪-১৯৮১), চুনী গোম্বামী (১৯৩৮-২০২০)। এই তালিকা সংক্ষিপ্তেরও সংক্ষিপ্ততম। এইসব নমস্য মানুষেরা বলতে গেলে কেউই দেশভাগ-জনিত কারণে বাস্তুচ্যুৎ ও দেশান্তরী নন। এদেরকে চলতি ভাষায় পূর্ববঙ্গীয় অর্থে বাঙাল বলা হলেও রিফিউজি বলা যায় না। দেশভাগের বহু বছর আগে থেকেই তাঁরা অবিভক্ত বাঙলার অগ্রসর নাগরিক রূপে তৎকালের অবিভক্ত বঙ্গদেশের রাজধানী শহর কলকাতার বাসিন্দা এবং বঙ্গীয় সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী বলে পরিগণিত। কিন্তু স্ব স্ব ক্ষেত্রে কৃতবিদ এইসব মানুষের বা তাঁদের উত্তর-পুরুষদের আর ঘরে ফেরা হয় নি। দেশভাগের রাজনৈতিক পালাবদল ও ভৌগোলিক বিভাজনের কারণে তাঁরাও চিরতরে তাঁদের ‘দ্যাশ’ হারিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ কেবল তৎকালের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে উন্মূল করেনি, পূর্বাপর প্রজন্মেরও হানি ঘটিয়েছে। প্রজন্মের পাশাপাশি পরম্পরা, ঐতিহ্য, ঐক্য ও সংহতিতেও ছেদ ঘটিয়েছে। দেশভাগ একটি নতুন সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম দিয়েছে চিরায়ত সামাজিক পাটাতনের বিনাশ ঘটিয়ে। দেশভাগের ফলাফল হয়েছে মিশ্র: হারানোর বিনিময়ে পাওয়া। আর দেশভাগের অঙ্কটির দৃশ্যপট যদিও রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসর, তথাপি এর প্রচ- প্রভাব পড়েছে উভয় প্রান্তের বিভাজিত মানুষের আত্মপরিচিতি ও আত্মস্মৃতিমালায়। এবং যার সুপ্ত বা প্রকাশ্য পড়েছে সামাজিক বিন্যাসে, সাংস্কৃতিক বুননে, ব্যক্তিগত আবেগের স্তরে। চিন্তা ও মননের পরিসরে এবং চেতনাপ্রবাহে দেশভাগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপস্থিতি ৭৫ বছর পরেও তিরোহিত হয় নি। বরং দেশভাগের বড় মাপের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনের আড়াল থেকে প্রান্তিক মানুষের হাহাকার , ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষত, পচন ও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে সামনে চলে আসছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, সময়ের পরিবর্তনে দেশভাগ রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিতর্ক পেরিয়ে ক্রমেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচর্চা ও সাহিত্য সাধনার মতো নিরাপদ ক্ষেত্রের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা এখনো জীবন্ত উপস্থিতিতে বিরাজমান এবং ‘জাতীয় ইতিহাস রচনার সমস্যা’ রূপে গবেষকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, ব্রিটিশ-ভারতের রক্ষক্ষয়ী বিভক্তির কারণ সম্পর্কে জানা ৭৫ বছর পরেও শেষ হয় না। নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল ব্যবহার করে গবেষকরা ১৯৪৭ সালের বিপর্যয়ের কারণগুলোর জন্য এখনো উত্তর খুঁজছেন, যা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল।
৪.
শুধু ১৯৪৭ সালেই নয়, ব্রিটিশরা বাংলা হয়ে ভারতের ক্ষমতা দখলের কারণে বাংলাকে এবং পরবর্তীতে ভারতের নানা অংশকে সময়-সময় রাজনৈতিক প্রয়োজনে ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে বিভক্ত ও বিন্যস্থ করে। ব্রিটিশদের যে ‘ভাগ করো ও শাসন করে’ নীতিকে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার নেপথ্য কারণ রূপে বিবেচনা করা হয়, মাটি ও ভূগোলের বিভাজনেও তা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল, যার দীর্ঘমেয়াদী কুপ্রভাব ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-কালে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। বাংলার প্রসঙ্গে বলা যায় যে, বাংলা তথা অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশ বা বেঙ্গল প্রভিন্সকে ভৌগোলিক বিপুলায়তন এবং বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ‘পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা’ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় বাংলা’ নামে অভিহিত করা হতো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বিভক্ত ভারত ও বিভক্ত বাংলায় পূর্ব ও পশ্চিমের অঞ্চল দুটি নতুন রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একটি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং অপরটি পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর প্রদেশগুলোর প্রধানমন্ত্রী পরিচিতি পায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আর প্রদেশগুলো পরিচিতি পায় রাজ্য হিসেবে। অন্যদিকে, ১৯৫৭ সালের পর পূর্ববঙ্গ পরিচিতি পায় পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে, যা ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই রাজনৈতিক পালাবদলের প্রভাব পড়েছে মানুষের পরিচিতিতে। কখনো তাঁরা ভারতীয় হয়েছেন, কখনো পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি। এর বাইরেও তাঁদের ধর্মীয় পরিচিতি হিন্দু বা মুসলিম, অনেক সময়ই প্রাধান্য পেয়েছে। এইসব রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় পরিচিতির চাপে তাঁদের জাতিগত মূল পরিচিতি ‘বাঙালি’ বহুলাংশেই চাপে পড়েছে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা পাকিস্তানি-পাঞ্জাবি-উর্দুর চাপ প্রতিহত ও পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। এতে বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচিতি দীর্ঘ অবদমনের পর রাষ্ট্রনৈতিক আত্মপরিচিতির সাংবিধানিক-রাজনৈতিক বৈধতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেশভাগের ফলে বাঙালির আত্মপরিচিতিতে যে বিভক্তি ও ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার কতটুকু উপশম হলো এবং বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্কট কতটুকু কমলো বা বাড়লো, ৭৫ বছর পর এমন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের যৌক্তিকতা এবং আত্মসমীক্ষার প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যায় না।
৫
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে চিরতরে বিদায়ের আগে ব্রিটিশদের যাবতীয় লুণ্ঠন ও অপশাসনের ইতিবৃত্ত ও জাতিগত নিপীড়ন চাপা পড়ে স্বাধীনতা ও দেশভাগের দ্বৈরথে সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আবর্তে। ভারত ভাগের অংশ হিসেবে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। অবিভক্ত বাঙলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা এবং অবশিষ্টাংশ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ গঠন করা হয়। তবে ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বা ভারতবিভক্তি, যা-ই বলা হোক না কেন, ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাঁক এবং পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বড় আকারের একটি দেশান্তরেরও ঘটনা। দেশভাগের ঘটনা ঐতিহাসিক নথিপথে যেমন লিপিবদ্ধ রয়েছে, তেমনিভাবে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে। বিপর্যস্ত ও ভোক্তভোগী পরিবারের পরম্পরায় ঘটনাটি অমোচনীয়। পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে গিয়ে প্রতিবারই এসব দেশান্তরী মানুষের মনে জাগে দেশভাগের স্মৃতি। সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চপদাধিকারীও দেশভাগের রাজনৈতিক অভিঘাতের আবেগ থেকে বিযুক্ত হতে পারেন নি।
প্রসঙ্গত সিপিএম যখন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায়, তখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর স্ত্রীর বৃহত্তর ঢাকা জেলায় তাঁদের পৈত্রিক নিবাসে বাংলা ভাগের পর প্রথম আগমনের কথা স্মরণযোগ্য। বসু পরিবারের দেশের মাটি ছোঁয়ার সময়কার আবেগময় বর্ণনা তৎকালের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছিল। এমনকি, যেখানে একসময় পরিবারের পূর্বপুরুষগণ তাঁদের দৈনন্দিন পূজা-আচার সম্পন্ন করতেন, সেই পরিত্যক্ত মন্দির থেকে জ্যোতি বসুর স্ত্রী ফিরে যাওয়ার সময় স্মৃতিস্বরূপ এক মুঠো মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, দীর্ঘবছর পর পূর্বপুরুষের একদার আবাস দেখে বহুমাত্রিক অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা প্রকাশিত হওয়াই স্বাভাবিক। পূর্বপুরুষের ভিটা, স্মৃতিমন্দির, কবরগাহ, ধর্মস্থান হয়তো পরিত্যক্ত কিংবা কালের করাল গ্রাসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু সেখানেই দেশভাগের ফলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পরবর্তী-প্রজন্ম কখনো ফিরে এসে ঐতিহ্য ও উত্তাধিকারের শেকড়ের ছোঁয়া পেয়েছেন। দেশভাগ ও ভৌগোলিক বিভাজন রাজনৈতিকভাবে মানুষকে বিছিন্ন করলেও মানবম-লীর আবেগ ও অনুভূতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরার জায়গাটিকে নস্যাৎ করতে পারেনি, যদি না কেউ, খুবই ব্যতিক্রম স্বরূপ, স্বেচ্ছায় নিজের অতীত ও পরিচিতি থেকে বিস্মৃত ও বিযুক্ত না হয়। কারণ, অনেক উদ্বাস্তুই বিদ্যমান বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনা এবং পরিস্থিতির কাছে হার মানে এইজন্য যে, “Refugees often find a conflict between the identity they have left behind and the one that lies before them. The boundary between the ‘self’ and the ‘other’ becomes futher exacerbated in a space of strong national identy.”
তথাপি, দেশভাগ নিয়ে ব্যক্তিগত ও বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে প্রশ্ন, সমীক্ষা, অনুসন্ধান ও দ্বিধার পাশাপাশি আত্মপরিচিতি পুনর্নিমাণের প্রচেষ্টা ৭৫ বছর পরেও তাৎপর্য হারায় না। রাজনৈতিকভাবে ‘সঠিক’ লেবেল এঁটে নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ‘দেশভাগের সঙ্কুলতায় বিহ্বল’ জনতার উপর যে বিভাজন ও দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই জনতাও ঘোর কাটিয়ে সচকিত হয়। সচেতন মন তখন বাস্তবের মাটির একদিকে দেখতে পায় একদল লোককে, যারা বিভাজন চেয়েছিলেন, অন্যদিকে, আরেক দল লোক, যারা বাটোয়ারা চান নি। তবে সবচেয়ে বড় যে দল বা অংশটি ছিলেন আমজনতা, তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্ত, আগুন, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও সশস্ত্র-উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ভাগাভাগি মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে ভাগাভাগি সম্পন্ন করা হয়েছিল সুদূর দিল্লিতে তাদের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এবং তা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিসরে। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ঘর-বাড়ি হারিয়েছেন এবং নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে মানব¯্রােতের সঙ্গে ভেসে গিয়েছেন। আর সেই নিরীহ জনতার বৃহদাংশই দাঙ্গা কবলিত ও দেশভাগের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুৎ হন। রাজনীতিবিদগণ তখন অনেকদুরে, ক্ষমতার অলিন্দে পদ-পদবী-সুযোগ-সুবিধা-সম্পদ ইত্যাদির ভাগ-বাটোয়ার ব্যস্ত ছিলেন। জনতার রক্তপাত দেখার মতো মানসিকতা তাঁদের অধিকাংশেরই তখন ছিল না। স্ব স্ব রাজনৈতিক বিজয়ে তাঁরা ছিলেন উৎফুল্ল ও খুশি এবং বিদ্যমান রক্তাক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতাদের অত্যল্প সংখ্যকই অনুভূতির প্রকাশ ও সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করতে ইচ্ছুক ছিলেন।
৬.
৭৫ বছরে নানাভাবে দেশভাগের ক্ষত মোচনের কাজ করা হয়েছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের নানা রকম প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। সংগ্রামশীল মানুষও সঙ্কুলতা কাটিয়ে নিজস্ব মাটি তৈরি করে পরিবর্তিত বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ‘দেশভাগ’ ঘটনাকে ভুলতে পারেন নি। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এই যে, দেশভাগ নিয়ে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আত্মসমীক্ষা, পরিচিতির সঙ্কট ও নানাবিধ চর্চা ও বিতর্ক এখনো পণ্ডিত মহলে যেমন টাটকা, তেমনিভাবে জনমানসেও সজিব। সর্বসাম্প্রতিক সমীক্ষায় তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সমীক্ষাটি চালিয়েছিল ভারতের ‘সি ভোটার’ নামের একটি সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে এই সমীক্ষায় অংশ নেন বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকগণ। এই সমীক্ষায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ২০২২ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এই সমীক্ষায় চুয়াল্লিশ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন, দেশভাগ তথা ভারত-পাকিস্তান ভাগ ঠিক হয় নি। কিন্তু ৪৬ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন যে, দেশভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। বড়ো মাপের এই সমীক্ষায় পাঁচ হাজার আটশো পনেরো জন ভারতীয় অংশ নেন। এর মধ্যে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান এবং গোয়ার মানুষজন দেশভাগ বা পার্টিশান-এর বিরুদ্ধে অভিমত দেন। সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী? এই প্রশ্নের জবাবে ষাট শতাংশ বলেছেন, ভারতের সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ। ভারতের পক্ষে নিরাপদ কি পাকিস্তান? এই প্রশ্নের জবাবে ৮৬ শতাংশ বলেছেন, না, পাকিস্তান নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। উল্লেখ্য, পনেরোটি ভাষায় এই সমীক্ষা চালানো হয়। ‘সি ভোটার’-এর সাহায্যকারী সংস্থা হিসাবে সমীক্ষায় কাজ করেছিল ‘সি পি আর’। একই প্রশ্ন যদি একটু ঘুরিয়ে করা হয়, তাহলে কেমন উত্তর পাওয়া যাবে, সমীক্ষায় তার উল্লেখ করা হয় নি। তবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘পাকিস্তানের পক্ষে নিরাপদ কি ভারত?’ এই প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশই বলবেন, না, ভারত মোটেও পাকিস্তান নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। যেমনটি ভারতীয়রা মনে করেন যে, পাকিস্তান নিরাপদ প্রতিবেশী নয়। যে বৈরিতার উত্তরাধিকার ৭৫ বছর আগে রক্ত ও মৃত্যুর পথে বিভাজন এনেছিল, সেই বৈরিতার অবসান যে এখনো হয় নি, জনসমীক্ষার তারও প্রমাণবহ। বিভক্তির জন্য সাতচল্লিশের যে নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, বছরের পর বছর দূরত্ব ও শত্রুতা জিইয়ে রাখার জন্য পরবর্তী নেতৃত্ব নিশ্চয় ইতিহাসের-কাঠগড়ায় নিজেদের দেখতে পাবেন।
সমীক্ষার আরেকটি প্রশ্ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তা হলো, ‘ভারতের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী?’ সিংহভাগের উত্তর ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এই প্রশ্নটি কিঞ্চিত বদলে যদি জানতে চাওয়া হয়, ‘বাংলাদেশের জন্যে কারা সব থেকে নিরাপদ প্রতিবেশী?’ এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বিকল্প খুঁজে পাওয়াও সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত প্রায়-পুরোটাই ভারতের সঙ্গে। অতি সামান্য সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমানের সঙ্গে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানার ৪,১৫৬ কিলোমিটার ভারতের সঙ্গে আর মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে মাত্র ২৭১ কিলোমিটার। ফলে ভারতের বাইরে অন্য কোনো নিকট-প্রতিবেশীর কথা বিবেচনায় আনা প্রাকৃতিক-ভূগোলের কারণেই প্রায়-অসম্ভব। তদুপরি মিয়ানমার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সীমান্তে সংঘাতের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে এবং তার দেশের দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে বৈরী-প্রতিবেশীর তকমা পেয়েছে।
পক্ষান্তরে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের আর্থ-সামাজিক-নিরাপত্তা ইত্যাদি যাবতীয় ইস্যু যেমনভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে নির্ভরশীল, তেমনিভাবে বাংলাদেশও তিন দিক দিয়েই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সীমান্তের এই নিবিড় সম্পর্কের পাশাপাশি ছিটমহল, অভিন্ন নদীসহ আরো অনেক সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আছে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, যাকে নস্যাৎ করেছে দেশভাগ। দেশভাগের পরেও কিছু বিষয় ভাগ হতে পারেনি: আবেগ, পরম্পরা, স্মৃতি ও শেকড়, যা দুই দেশের মানুষই বহন করছেন। ফলে কার্যক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত যেন নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিবেশি ভাবতে পারে, তার জন্য স্ব স্ব দেশের সরকারগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজের পক্ষেও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গৃহীত হওয়া উচিত। অন্তত, শান্তিকামী ও মুক্তমনা মানুষদের, যাদের নূন্যতম ইতিহাসবোধ, আত্মমর্যাদা ও স্বকীয় পরিচিতি আছে এবং হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা ও বিভেদের অতীত সম্পর্কে অত্যল্প হলেও পাঠ রয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই উভয় দেশ ও দেশের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য, মৈত্রী ও সম্মানজনক সহাবস্থানের প্রশ্নে আপোসহীন হতেই হবে।
৭.
সন্দেহ নেই, দেশভাগ বিভাজিত ভূগোলোর বিভাজিত মানুষের জীবন-ইতিহাস ভাঙা-গড়া, নির্মাণ-বিনির্মাণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রসঙ্গ। যে ইতিহাসের অর্ধেক দৃশ্যমান ও নিত্যসঙ্গী; বাকী অর্ধেক অদৃশ্য, যা ফেলে আসতে হয়েছে। রাজনৈতিক আইন কিংবা সাংবিধানিক আলোচনার পরিরিধিতে ব্যক্তি মানুষের এসব ত্যাগ স্থান পায় নি। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় সীমান্তের দুই পারের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের জীবনও যে বিভাজিত হলো, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে, সে জীবনের বিপর্যয় ও অভিজ্ঞতাকে ‘সরকারি ভাষ্যে’ তুলে ধরার কোনো পরিসরই রাখা হয় নি। পরিবেশটি ছিল এমনই যে, কে কাকে তাড়িয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করতে পারবে, সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতা মজবুত করেছেন আর আমজনতা সামাজিক-আর্থিকভাবে তৃণমূল স্তরে নিজেকে সুসংহত করেছেন। এমতাবস্থায়, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু, নিরিহ মানুষেরা আলিঙ্গণ করেছেন দেশভাগের জ্বালা, বিভাজন, সীমাহীন ত্যাগ ও দুর্ভোগ। এ কথাও আমরা ভুলে যাই যে, ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই আলোচনার টেবিলে বা আইনসভার বৈঠকে বসেই নিষ্পন্ন হয় নি, বরং দক্ষিণ এশিয়া নামের আসমুদ্রব্যাপী একক ও একটি জীবন্ত ভৌগোলিক ইউনিটকে কাটাছেড়া করা হয়েছে। বিভাজিত ও কর্তিত হয়েছে নদী, পাহাড়, বনাঞ্চল, মানুষ ও পশু-পাখির আবাস। সুন্দরবন, কচ্ছের রান কিংবা থর মরুর জীববৈচিত্র ও প্রাণিকূল পর্যন্ত উন্মূল হয়েছে এই বিভাজনের কারণে। এবং বহু ক্ষেত্রেই অসংখ্য মানুষের ব্যক্তিগত ও পরিবারিক জীবন পর্যন্ত তছনছ হয়ে গিয়েছে। সীমান্তরেখায় অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ যার প্রমাণবহ।
রাজনীতির চৌহদ্দীর বাইরে এসে মানবিক বিপর্যয়ের এইসব ইতিবৃত্ত ও স্মৃতিমালার গুরুত্ব কতটুকু? কিংবা এসবের আদৌ কোনো তুল্যমূল্য ও গুরুত্ব রয়েছে? ৭৫ বছর পর দেশভাগের বহুমুখী অভিঘাতসমূহ কতটুকু জীবন্ত রয়েছে? কিংবা কতটুকু জীবন্ত থাকা উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকমের হওয়াই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি তরুণী আনাম জাকারিয়া যেমন দেশভাগ সম্পর্কে কয়েক প্রজন্ম পরের অভিব্যক্তি সংগ্রহ করেন তার গ্রন্থসমূহে তেমনি অনেকেই রিফিউজি অতীত মুছে নতুন পরিচিতি নির্মাণে অতি সাবধানতায় তৎপর হন। দেশভাগ নিয়ে রাজনীতিতে যেমন দ্বিধার বিস্তার, ব্যক্তি ও সমাজজীবনে আর জনমানসেও রয়েছে বিহ্বলতা। বরং বলা ভালো, একটি অভিযোজন ধারায় দেশভাগকে আত্মস্থ করেই এগিয়ে চলেছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুৎ মানুষজন। কলকাতার পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ বা আলিপুরের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোতে নতুন বাসিন্দারা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করছেন। ঢাকার উয়ারি, শাঁখারী বাজার, গেন্ডারিয়ায় নবাগতরা আরামে দিনযাপন করছেন। কলকাতার আশেপাশে যেসব ছিল ‘রিফিউজি কলোনি’, সেগুলোর চমৎকার নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভারত প্রত্যাগতদের যে ‘রিফিউজি পাড়া’ ছিল, সেগুলো নতুন নতুন বর্ণাঢ্য নামে অলঙ্কৃত হয়েছে। রাজনীতি যে দেশভাগ এনেছিল, সামাজিক বিবর্তনে সেগুলোর বহুলাংশ হয়ত সহনীয় হয়ে গেছে। কিন্তু ৭৫ বছর পরেও দেশভাগের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে সমীক্ষার অন্ত নেই। দেশভাগের স্মৃতি ও দ্রষ্টব্য সংরক্ষণ বন্ধ নেই। দেশভাগের বহুমাত্রিক অভিঘাত মানুষ-সমাজ-রাজনীতিতে কতটুকু জীবন্ত রয়েছে কিংবা কতটুকু জীবন্ত থাকা উচিত, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের ‘যুগান্তকারী আলোচ্য বিষয়বস্তু’ হিসেবে দেশভাগ নামক প্রপঞ্চটি সামনে এসে দাঁড়াবেই। আর তখনই দেখতে পাওয়া যায় যে, রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতায় জারিত উগ্র জাতীয়তাবাদী পেশাদার ঐতিহাসিকদের চেতনাবোধের প্রলেপ দেশভাগের যাবতীয় প্রপঞ্চে প্রবলভাবে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। আবার ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাসবেত্তাগণ হিন্দু ও মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে যে ইতিহাস রচনা করেছেন, তা দেশভাগের পূর্ব ও পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের চর্বিকর্চবণ মাত্র। এই উভয়বিধ ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতা এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভক্তিকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বিশেষত ভাষা ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক, পশ্চাৎপদ ও সংখ্যালঘুতর মানুষের কথা সরকারি ইতিহাসভাষ্যে প্রায়-অনুপস্থিত। এতে দেশভাগের মূল¯্রােতের ঘটনাবলির আড়ালে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রের ও সঙ্কটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু উপাখ্যান চাপা পড়ে যায়। এবং দেশভাগ নামক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাসুল জনজাতি ও প্রান্তিক সম্প্রদায়সমূহের মানবম-লী আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কীভাবে বহণ করেছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটুকু আদৌ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। বস্তুতপক্ষে, দেশভাগের অফিসিয়াল ইতিহাসের ভাষ্যে মূলত আলোচিত হয়েছে রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়াবলি, যে ইতিহাস কখনোই সেইসব মানুষের জীবন আর অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেনি. যাঁরা দেশভাগের সঙ্কটকাল পাড়ি দিয়েছিলেন। এটাও ইতিহাসের ব্যর্থতা যে, দেশভাগের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ মানুষের মনে কেমন ছাপ ফেলেছিল, কীভাবে মানুষের পরিচিতির সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, অনিশ্চয়তার অমানিশা নেমে এসেছিল সমাজ জীবনে এবং সর্বপরি দেশভাগের কারণে সমাজে ও মানুষের জীবনে যে ক্ষত, হতাশা ও বেদনা আরোপিত হয়েছিল তা পুরোপুরিভাবে চিত্রিত করা হয়নি।
বরং ইংরেজ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাপ-আলোচনা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির টানাপোড়েনের বৃত্তেই আবর্তিত হয়েছে দেশভাগের যাবতীয় অনুষঙ্গ। দেশভাগের রেকর্ড বা নথিপত্রের বিশাল ভা-ারও এক মানব বিপর্যয় মিশ্রিত স্বাধীনতার তথ্য উপস্থাপন করে, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো ট্র্যাজিক দেশভাগ। জন্মভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার বাস্তবতা, উদ্বাস্তু মানুষের জন¯্রােত, সাম্প্রদায়িত দাঙ্গা, দেশত্যাগ, ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি নির্মম ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে যে দেশভাগ, যা আসলে দেশের ব্যবচ্ছেদ, মানুষের বিচ্ছেদ আর এসবই সংঘটিত হয়েছে একটি দীর্ঘ সময়কালের পরিধিতে এবং তা সুপ্তভাবে অব্যাহত থেকেছে সরকারিভাবে দেশবিভক্তির অনেক বছর পর্যন্ত। এমনকি, দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও দেশভাগ ও বিভাজনের ঘটনাবলির ঐতিহাসিক দায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাড়িত করছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নাগরিকত্ব, জাতিত্ব, আত্মপরিচিতি, সীমান্ত, সমাজ ব্যবস্থা এবং সর্বপরি মানবমণ্ডলীকে।
৮.
বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার গণমাধ্যমে দেশভাগের ৭৫ বছরের পর্যালোচনায় অপ্রাপ্তির ঐতিহাসিক দায়বোধ থেকে উচ্চারিত কথাগুলোকেই উপসংহার হিসাবে বলা যেতে পারে। ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের ভাষ্যে: ” Seventy-five years after the Partition of the Indian subcontinent, we are still a long way from understanding the complex ways in which this event affected the everyday lives of people and communities then, and how it still continues to shape our collective consciousness, politics and ways of being.”
কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ও এ বিষয়ে সরব। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ যে কতটাই উপরিতলের ভাগ ছিল, অন্তরটানে দুই বাংলা যে কতটা যুক্ত ছিল, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় তার সাক্ষ্য বলে মনে করে পত্রিকাটি। তাদের ভাষ্যে: অর্ধশতাধিক বছর পরে ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, ১৯৭১ সালের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবে কেবল পূর্ববঙ্গের দিক থেকেই দেখা হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও যে তার একটা বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, তা যেন এখনো ততটা বোঝা হয় নি। সেই গুরুত্ব খতিয়ে দেখতে গিয়ে যদি দাবি করা হয়, বঙ্গীয় হিন্দু ও মুসলমান সমাজ এত বেশি কাছাকাছি তার আগে বা পরে কখনোই আসেনি, খুব ভুল হবে কি? বিশ শতকের ইতিহাসে এমন আর একটি মুহূর্ত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, যখন দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত জনসমাজ একই আবেগে থরোথরো, একই প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভাসিত। বঙ্গভঙ্গ-স্বদেশি যুগের কথা মনে করতে পারেন কেউ। ইতিহাস-পাঠক তাঁকে তখন মনে করিয়ে দিতে পারেন, আকারে ও প্রকারে দুই সময়ের আন্দোলিত জনসমাজের কোনো তুলনাই হয় না। একে তো স্বদেশি আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছিল কম, তার উপরে বাঙালি মুসলমান তাতে কতখানি অংশ নিয়েছিলেন, বিতর্কের বিষয়। পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতেও একত্র রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রসার অতখানি ছিল না। ১৯৩০-এর দশক থেকে দুই সমাজ আরো দূরবর্তী হতে শুরু করে, যার চরম বিপর্যয় ঘটে কিংবা রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির মাধ্যমে ঘটানো হয় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়। আবার ১৯৭১ সালের দিনগুলো বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে এক দুর্লভ মাহাত্ম্যে ও সৌহার্দ্যে পরিপূর্ণ। আর সব পরিচয়, বিশেষত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরত্ব তুচ্ছ হয়ে যায় বাঙালি পরিচয়ের সামনে। বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দু-মুসলমান হাতে হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে দেখে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা চুপ থাকতে পারেনি। দেশভাগের বিশাল দূরত্ব ১৯৭১ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিল আর কলকাতার বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক প্রকাশ্যে লিপিবদ্ধ করলেন ঐতিহাসিক ভাষ্য: যা প্রকাশ পায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে সন্তোষকুমার ঘোষ লিখছেন: “ভুল, ভুল, একেবারে ভুল। সাত কোটি বাঙালিরে জননী মানুষও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভুলটা ধরা পড়েছে এত দিনে। ওঁরা ধরিয়ে দিলেন। আমরা কৃতজ্ঞ।”
দেশভাগের ক্ষত সারিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ ও একাকার করেছিল। বাঙালির আত্মপরিচয়ের দীপ্তিতে মুছে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানির অতীতের গর্ভে লুক্কায়িত ভ্রাতৃঘাতের পাপ। বাংলার আকাশে মুক্তির লাল সূর্য উদ্ভাসিত করেছিল প্রতিটি বাঙালিকে। ৭৫ বছর পেরিয়ে গেলো দেশভাগের বিভাজনের পথ-পরিক্রমায়। কিন্তু ১৯৭১-এর মতো আত্মপরিচিতির উদ্ভাস যুক্ত-বাঙালির ঐতিহাসিক ঐক্যের ছায়াপাতে আবার কবে দেখতে পাওয়া যাবে?
তথ্যসূত্র
আহমেদ কামাল, ‘দেশবিভাগের অভিজ্ঞতা ও জাতীয় ইতিহাস রচনার সমস্যা’, প্রতিচিন্তা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১১ সংখ্যা।
দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ গীতিকা, ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য ভবন, ২০১৫।
ঋত্বিককুমার ঘটক, মেঘে ঢাকা তারা: চিত্রনাট্য ও সমালোচনা, ঢাকা: নালন্দা, ২০১৬।
ঋত্বিককুমার ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ২০১৩।
মাহফুজ পারভেজ, বঙ্গবন্ধু: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ২০২৩.
মাহফুজ পারভেজ, ‘দেশভাগের রক্তাক্ত পদচিহ্ন’, কালি ও কলম, ২২ নভেম্বর ২০১৭।
মাহফুজ পারভেজ, ‘ঋত্বিক ঘটক: চলচ্চিত্রের শিল্পিত কারিগর’, বার্তা২৪.কম।
মাহফুজ পারভেজ, ‘সুবর্ণরেখা: নদী ও মানুষের আখ্যান’,বাতা২৪.কম।
প্রথম আলো, ২৯ মার্চ, ২০২৩
জয়া চ্যাচার্জি, বাংলা ভাগ হলো, ঢাকা: ইউপিএল, ২০১৪।
জয়া চ্যাটার্জি, দেশভাগের অর্জন: বাঙলা ও ভারত (১৯৪৭-১৯৬৭), ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২।
‘৬০ শতাংশ ভারতীয় মনে করে বাংলাদেশ নিরাপদ প্রতিবেশী’, মানব জমিন, ৫ অক্টোবর, ২০২২।
সেমন্তী ঘোষ, ‘একাত্তর ছিল এ বঙ্গের বাঙালির পরিচয় গৌরবের সেরা পরীক্ষা’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ মার্চ, ২০২৩
Ali Madeeh Hashmi, Love and Revolution: Faiz Ahmed Faiz-The Authorized Biography, New Delhi: Rupa Publications India, 2016.
Alvin Powell, “Using new technology and techniques, scholars seek answers for 1947 cataclysm that killed millions”, Harvard Gazette, April 6, 2018.
Anam Zakaria, 1971: A People's History from Bangladesh, Pakistan and India, London: Penguin Random House, 2019.
Anam Zakaria, Between the Great Divide: A Journey into Pakistan-administered Kashmir, New Delhi: HarperCollins India, 2018.
Anam Zakaria, The Footprints of Partition: Narratives of Four Generations of Pakistanis and India, New York: HarperCollins, 2015.
Elena Montazemi Safari, ‘The Refugee Identity Crisis’, BizGees, 7 May 2021.
Estelle Dryland, Faiz Ahmed Faiz: Urdu Poet of Social Realism, Karachi: Vanguard Books, 1993.
Gopi Chand Narang, Urdu Language and Literature: Critical Perspectives, Delhi: Sterling Pub. Ltd., 1987.
John Zaw, ‘Suu Kyi’s Call for Peace Sounds Hollow’, UCANEWS, 13 October, 2017.
Rup Kumar Barman, ‘Partition of Bengal and Struggle for Existance of the Host Society: The Case of the Rajbanshis of North Bengal’ in Chhanda Chatterjee (ed.), The Partition of the Indian Subcontinent (1947) and Beyond: Uneasy Borders, New Delhi: Routledge India, 2023.
‘75 Years of Partition’ The Daily Star, 7 October, 2022.
[1] ‘75 Years of Partition’ The Daily Star, 7 October, 2022.