শরীর দিয়ে কথা বলেন কিশোরগঞ্জের রিফাত

  • তন্ময় আলমগীর, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রিফাত ইসলাম

রিফাত ইসলাম

‘মূকাভিনয়’ শব্দটি এলেই চলে আসে পার্থ প্রতিম মজুমদারের নাম। এই মূকাভিনেতা কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের আকাশেই জ্বলছেন তারা হয়ে। কিন্তু পার্থ প্রতিম মজুমদারের পর আর কে আছেন?

কাছাকাছি কারো নাম আসে না। একটু দূর গেলে আরো কয়েকটা নাম আসবে। তবে সেগুলো সাধারণের কাছে পরিচিত নয়। আজকের গল্পের নায়কও অপরিচিত। তরুণ এক ‘নীরবতার শিল্পী’।

বিজ্ঞাপন

এই মূকাভিনেতার নাম রিফাত ইসলাম। বাড়ি কিশোরগঞ্জ। তবে তার খ্যাতি মফস্বল শহর ছাপিয়ে। ভারতেও দেখিয়ে এসেছেন তার প্রতিভার ঝলক। মানুষ অভিভূত হয় তার অভিনয় দেখে। যারা দেখেন, তাদের একটা অংশ জানেন না, এই অভিনয়ের পরিচয়!

রিফাত ইসলাম

ইউটিউবে একটি ভিডিও পাওয়া যায় ‘টু ইন ওয়ান’ শিরোনামে। মূকাভিনয়ের এই ভিডিওটি রিফাতের ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে আপ করা আছে। এটি মঞ্চস্থ হয় ঢাকায়।

বিজ্ঞাপন

ভিডিওতে দেখা যায় দুই পাশে দু’টি পর্দা। মাঝখানে একটা শরীরি নাচ। একটা শরীর পুরুষের, অন্যটা নারীর। পুরুষের শরীর দেখে চেনা যায়, তিনি রিফাত ইসলাম। নারীর শরীরটি কার? ওই শরীরটিও তার, সেটা স্পষ্ট হয় অভিনয়ের শেষের দিকে। একই শরীরে দুইরকম উপস্থাপনা!

ব্যক্তিগত ইউটিউবে এই উপস্থাপনায় দর্শকসংখ্যা একেবারেই কম। তবে যারা একবার দেখেছেন, তারা বার বার দেখতে চান। এদেরই একজন সাংবাদিক আহমদ আমিন। রিফাত ইসলামকে আগে থেকেই চিনতেন। জানতেন মফস্বলের এক সংবাদকর্মী আর ভিডিও এডিটর হিসেবে। রিফাত মূকাভিনয় করেন, সেটাও জানতেন। কিন্তু এতোটা নিখুঁত জানা ছিলো না আহমদ আমিনের।তিনি বললেন, ‘ইউটিউব ঘাঁটতে গিয়ে ভিডিওটি আমার সামনে আসে। পরিচিত মুখ দেখে কৌতুহলী হই। দেখার পর তাজ্জব বনে যাই। জীবনে অনেক মূকাভিনয় দেখেছি। কিন্তু রিফাতের মতো প্রতিভার দেখা পাইনি।’

দেশের শীর্ষ একটি সংবাদমাধ্যমের পাঠক সংগঠনের অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিলেন রিফাত। গাজীপুরের ওই মঞ্চে তিনি উপস্থাপন করেন রোবট-এর চরিত্র। গল্পের প্লট ছিলো হরতাল। একটি রোবটকে পাঠানো হয় ফটো সাংবাদিকতার কাজ দিয়ে। ক্যামেরা নিয়ে রোবট তার কাজ করছিলো। হঠাৎ উড়ে আসে একটি গুলি। ঠিক সেই সময়ই এক শিশুর কান্না শুনা যায়। গুলিবিদ্ধ রোবট যেভাবে শিশুকে উদ্ধার করে, সেই নীরব অভিনয় দেখে মঞ্চের সামনে বাহ্বা পড়ে যায়।

সেদিনের সেই বাহ্বা আকাশ কাঁপিয়েছিলো, এমনটাই জানালেন ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত মো. জিয়াউর রহমান। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। ওই সময় ছিলেন পত্রিকাটির পাঠক সংগঠনের কিশোরগঞ্জ জেলার সভাপতি। রিফাতকে ওই অনুষ্ঠানে নিয়ে যান তিনিই।

জিয়াউর রহমান বলেন, ‘অন্যদের উপস্থাপনা ছিলো গতানুগতিক। এর মধ্যে রিফাতের ব্যতিক্রম উপস্থাপনা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন ছিলেন সাইদুজ্জামান রওশন। তিনি রিফাতকে ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কৃত করেন।’

রিফাত ইসলাম

এ প্রসঙ্গে রিফাত বললেন, ‘রওশন ভাই আমাকে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত থাকতে বললেন। পরে জিজ্ঞেস করলেন অভিনয়ের কস্টিউম তৈরি করতে কেমন খরচ পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই সেই খরচটা আমাকে দিয়ে দেন তিনি।’

এই ঘটনাটা রিফাতের জন্য ছিলো উৎসাহের। অভিনয় করতে গিয়ে এমন আরো উৎসাহ পাচ্ছেন তিনি। এইসব উৎসাহ থেকে তৈরি হচ্ছে শক্তি। সেই শক্তিতেই মাথা তুলতে চান তিনি।

মূকাভিনয়ের উৎসাহটা কীভাবে পেলেন তিনি? উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, প্রথমে হিন্দি গানের সঙ্গে গ্রামের বিয়েবাড়িতে নাচ করতেন। নাচের উৎসাহ পেয়েছেন বড় ভাই গাজী মাজহারুল ইসলামের কাছ থেকে। গ্রামের অনুষ্ঠানে ভাই নাচতেন। দর্শকের বাহ্বা পেতেন। সেই থেকে তার লোভ হয় নাচ শেখার।

একটা সময় দেখা গেলো শহরতলিতে বড় কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেখানে ডাক পড়তো রিফাতের। নাচতেন তুমুল শব্দে গানের সঙ্গে। মাইকেল জ্যাকসনের নাচও নেচেছেন তিনি। তখন মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যু হয়েছে। তখন তার গান বাংলাদেশের শহর-গ্রামে ভাইরাল। এর সঙ্গে স্থানীয় পরিমন্ডলে ভাইরাল হয়ে উঠলেন রিফাতও।

এভাবে কিছুদিন চললো। রিফাত নাচ দেখিয়ে ক্লান্ত। এবার নতুন কিছু চাই। নতুন কিছু তৈরি করতে হলে দরকার নতুন কিছু জানা। রিফাত বলেন ‘আমি দেখলাম, শহরের পরিশীলিত লোকেরা আমার এই নাচ গ্রহণ করছেন না। শহরতলির মঞ্চে হইহই তুলতে পেরেছি। তবে শিল্প-সংস্কৃতির লোকেরা আমাকে এড়িয়ে চলতেন। এটা আমাকে আঘাত করলো।’

রিফাত ইসলাম

তিনি ইউটিউব ঘাঁটলেন। দেখতে থাকলেন বিভিন্ন নাচের মুদ্রা। কিছু নাচ দেখলেন, নির্বাক। শরীর দিয়েই সব বলা হয়ে যায়। ওই নাচগুলো ভালো লাগতে শুরু করলো তার। কেবল নাচ নয়, কথা না বলে অভিনয় করার দিকে ঝুঁকলেন তিনি।

তখনো রিফাত জানেন না, এই অভিনয়ের নাম কী।

তিনি বলেন, ‘মূকাভিনয়ের পুরোপুরি ধারণা আসে মূকাভিনেতা মীর লোকমান ভাইয়ের থেকে। ২০১৬ সালে একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে পরিচয়। বলা যায় সেদিন থেকেই মূকাভিনয়ে কাজ শুরু করি। লোকমান ভাইয়ের সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসব ও ভারতের ত্রিপুরায় একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশ নেই।’

ধারণা পাওয়ার পর কলা-কৌশল শিখলেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে রিফাত জানালেন ‘আমি ইউটিউব থেকে নানা মুদ্রা শিখতে থাকলাম। পরে ওগুলোকে এক করে প্যাকেজ বানালাম।’

তিনি বললেন, ‘আমার মনে হলো, কাজের ভেতর গল্প থাকতে হয়। গল্প মানুষকে টানে। পরে আমি কিছু গল্প তৈরি করলাম। ওগুলোর বিপরীতে তৈরি করলাম অভিনয়ের আলাদা কৌশল। যখন গল্প নিয়ে অভিনয় শুরু করতে থাকলাম, খুব সাড়া পেলাম।’

সেগুলো উপস্থাপনা করতে লাগলেন কিশোরগঞ্জ শহরের শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে। শহরে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, ‘জলছবি’। এর সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান কায়েস। তিনি তাকে সুযোগ করে দিলেন। সভাপতি বিপুল মেহেদি তাকে নিয়ে কাজে নামলেন। এরপর থেকে শুরু হলো রিফাত-এর নান্দনিক যাত্রা। এই যাত্রা কঠিন, পথ দীর্ঘ। তবে ‘দূর’ যেতে হলে সেই দীর্ঘ পথ-ই পাড়ি দিতে হবে তাকে।

রিফাত ইসলাম

বাবা রফিকুল ইসলাম, মা রেনুয়ারা খাতুন তাকে নিয়ে আশাবাদী। অথচ একটা সময় ছিলো, এইসব কাজে বাবা এবং মা বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। এখন ছেলের খ্যাতি ছড়াতে শুরু করেছে। খ্যাতির সঙ্গে সামনে থেকে সরে গেছে পারিবারিক বাধাও। মা রেনুয়ারা খাতুন যখন বাড়ির বাইরে যান। ছেলের সুনাম কানে আসে। লোকেরা বাড়িতে এসে ছেলের খোঁজ করেন। এতটুকুতেই তাঁরা খুশী।

পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করছেন। এর এডিটর ইন চিফ আহমাদ ফরিদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, রিফাতের পক্ষে কতদূর যাওয়া সম্ভব? তিনি সোজা জানালেন, ‘অনেক দূর’।

সত্যিই অনেক দূর যাবার স্বপ্ন নিয়ে এগুচ্ছে রিফাত। মুখাভিনয়ের পাশাপাশি একজন তুখোর অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছা তার। শিল্পচর্চায় নিবেদিত প্রাণ এই তরুণের মাঝে সেসব গুণাবলী আছে তাতে সন্দেহ নেই।