সংগীতের রত্নখনি বাংলাদেশ: পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো ছেলে-মেয়ে রয়েছে যাদের কণ্ঠ এতো ভালো শুধু একটু পরিশ্রম করলে ও সঠিক পরিচর্যা পেলে তারা শীর্ষে যেতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববরেণ্য ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী।
তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটা রত্নখনি। এখানে এতো ভালো ছেলে-মেয়ে রয়েছে যাদের কণ্ঠস্বর এতো উন্নত, এতো ভালো বিশেষ করে যারা রবীন্দ্রনাথের গান করেন এবং আরও অন্যান্য গান যারা করেন। অনেকেই আসেন আমার কাছে শেখার জন্য। আসলে এদের রক্ষা করা উচিত, এদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত। আমি একটা অনলাইন ক্লাস করতে চাই। এই রত্নখনিদের বাঁচিয়ে রাখতে দরকার একটা শিক্ষা পদ্ধতি এবং অদম্য পরিশ্রম করার মানসিকতা।’
রোববার (২৮ মার্চ) দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন বিখ্যাত এই সংগীতশিল্পী। তিনি মূলত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে ‘রাগ’ সংগীত গাইতে আসেন।
পৈত্রিক সূত্রে বাঙালি এই পণ্ডিত বাংলাদেশের জন্য কিছু করার প্রবল ইচ্ছা থেকে বলেন, “সরকার যদি ব্যবস্থা করে এবং যদি একটা অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমি ওদের শেখাতে পারবো। নির্দিষ্ট একটা সময় থাকলো। তাতে আমি বাংলা ভাষায় বোঝাতে পারবো।”
কিভাবে বাংলাদেশের সহযোগিতা করতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার (বাংলাদেশ) বাছা বাছা যদি কুড়িটা বা পঞ্চাশটা ছেলে-মেয়ে হয়, এমনকি যদি ১০ জনও হয়, একটা দেশকে চেনানোর জন্য সেই ১০ জন শিল্পীই যথেষ্ট। এই যেমন ধরুন একজন লতা মঙ্গেশকরই ভারতবর্ষের পরিচয় দিতে যথেষ্ট।
তিনি বলেন, এখানে যারা অল্প বয়সী, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছর বা ১৮-২০ বছর। যাদের ভেতর সংগীতের বীজ আছে, তাদের যদি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে বা তারা যদি আসে বা আমি যদি কখনও আসি তাদের যদি একটা শিক্ষা পদ্ধতির ব্যবস্থা করা যায় যেটা প্রথমে হয়তো অনলাইনে হলো। পরে তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে আমার কাছে পাঠানো হলো। সেটা যদি সরকারিভাবে করা যায় তাহলে ভালো। আর আমি অনলাইনে একটা ক্লাস করি তাতে কিছু শেখাতে পারব।
বিখ্যাত সংগীতশিল্পী অজয় চক্রবর্তী বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময় থাকলো, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যেভাবে করছে। সেভাবে একটা অনলাইন ক্লাসও যদি করা যায়। আমাকে পারিশ্রমিক দেওয়াটা বড় কথা নয়, কিন্তু সবাই যেনো উপভোগ করতে পারে, ফায়দা নিতে পারে, লাভ নিতে পারে। মনে রাখতে হবে খুব কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এটা সম্ভব। আমি বলে দিলাম এটি ২০০ বার করতে হবে, যদি কেউ ২০ করে তাহলে তো হবে না। আমার ইচ্ছা যদি মাসে দু’দিন করেও একটা অনলাইন ক্লাস বড় করে আয়োজন করা যায় কলকাতা থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য। আর পরে যখন আসলাম পুরোটা দেখলাম মনিটর করলাম।
তিনি বলেন, যদি ৫০০ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে হতে ১০ জনকে বললাম ওদের কলকাতা পাঠিয়ে দেন আমি দেখাশোনা করব। ১০টা বাচ্চাকে ভালো করে রেওয়াজ করালাম। সংগীতের অন্যতম পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। ভারতে যন্ত্র সংগীতের যে একটা বিরাট প্রচার এবং প্রসার আছে তার পুরোধা হচ্ছে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, পণ্ডিত নিখির রঞ্জন বন্ধ্যোপাধ্যায় আরও অগণিত তারা সবাই বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ছাত্র। তারা সব বাংলাদেশের তৈরি, আজকে বাংলাদেশ যদি না থাকত তাহলে পঞ্চ কবির গান দিজেন্দ্রনাথ লাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন, রজনীকান্ত এই পঞ্চ কবির গান হতো না। বাংলাদেশে যেভাবে শ্রদ্ধার সাথে এই পঞ্চ কবির গান পালিত হয় এবং পরিবেশিত হয়। এই পঞ্চ কবির গান ওই বাংলায় (ভারতবর্ষে) এভাবে প্রচার প্রসার হয় না। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান হয় কিছুটা, নজরুল গীতি হয়। অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত ভারতে তো জানেনই না কেউ রবীন্দ্রনাথের মতো দার্শনিক গত ১০০ বছরে আর জন্মাননি। যিনি ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের শ্রষ্টা।
তিনি আরোও বলেন, পরিশ্রম করার মানসিকতা বাংলাদেশে কমে গেছে। পশ্চিমবঙ্গেও কমে গেছে ভীষণভাবে কমে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এতো সুন্দর সুন্দর কণ্ঠ আছে। আমাদের পরিচিত ছেলে-মেয়েরা আছে তারাও এতো ভালো গান করে কিন্তু তারা জানে না তারাও শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তাদের অনুষ্ঠান সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে।
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বলেন, ছোটবেলায় শুরু না করলে ২৬ বছর বা ২৮ বছর বয়সে শুরু করলে তো হবে না। পড়াশোনা যেমন ৩ বছরে শুরু করি তেমনি গানও ৩, ৪, ৫ বছর বয়সে শুরু করা উচিত। সেজন্য শ্রুতি নন্দনে সাড়ে ৫-৬ বছর থেকে ১২ বছর পেরিয়ে গেলে আর নিই না। ছোট বয়সে যদি না গ্রহণ করতে পারেন তাহলে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে আমি যেন একটা নতুন ‘রাগ’ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের জন্য আমি গাই। রাগের কোন পরিচয় সেদিন অনুষ্ঠানে দিতে পারিনি। রাগ একটা সমুদ্রের মতো। আর সমুদ্রকে একটা গ্লাসে করে পরিবেশন করা যায় না। একটা রাগ এর পরিচয় প্রচার প্রসার করতে গেলে তার বিস্তার দেখাতে গেলে সময়ের প্রয়োজন হয়। মনে হয়েছে আমি গঙ্গার জলে গঙ্গার পূজো করেছি। বাংলাদেশের এই সংগীত প্রেমি মানুষ তাদের জন্য পরিবেশনা। নাম দিয়েছি ‘মৈত্রি রাগ’। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সবসময় মৈত্রি ছিলো। অতিথি পরায়ণতা বাংলাতে বেশি্ ভারতবর্ষে কমে গেছে কোনদিনই এতোটা ছিল না যেটা বাংলাদেশে আছে। এখানে অবিশ্বাস্য ভালোবাসা মানুষের প্রতি আছে।
শেখ মুজিবুর রহমান জি’র মতো মানুষ ছিলেন বলেই আমার নতুন রাগটি সৃষ্টি হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ রাগ নতুন গন্ধ পাওয়া গেছে। আমি বহুবার মুজিবুর রহমান জি’র বক্তৃতা শুনেছি তার কণ্ঠ এখনো আমার কানে বাজে। সেই কণ্ঠকে চোখে দেখিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের উন্নতির জন্য তার আত্মা সচেতন আছে। আমি চাই সংগীতে বাংলাদেশ আবার শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করুক, উন্নতি করুক এবং তরুণ ছেলে-মেয়েদের জন্য আমি যদি কিছু করতে পারি। সেটা আমার সব থেকে বড় কাজ হবে। আমি যেহেতু এই বাংলার ছেলে আমি যদি কিছুটা ফিরিয়ে দিতে পারি এটা আমার কাছে বড় অর্জন হবে।
এখন হয়তো কলকাতা থাকি কিন্তু আপনাদেরই একজন ছেলে। যেন এই দেশকে কিছু ফেরত দিতে পারি এজন্য আপনারা আমাকে আর্শীবাদ করুন। আমার যোগ্যতা আছে, আমি খুবই যোগ্য কিন্তু তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যেগুলো বলবো সেগুলো শুনতে হবে। না শুনলে তো হবে না।