সাদি’দার এই চলে যাওয়া মানতে পারছে না শান্তিনিকেতন : লিলি ইসলাম
আমি শান্তিনিকেতনে যাই ১৯৮১ সালে। তখন সাদি’দা ফাইনাল দিচ্ছেন। সে সময়ই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার মনে আছে, প্রথম পরিচয়েই সাদি’দাকে জেনেছি, অনেক আন্তরিক। তখন তো শান্তিনিকেতনে খুব বেশি মানুষ যেত না, ফলে যে কজন আমরা এখান থেকে যেতাম, আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। সাদি’দাকে সেখানে আমি পেয়েছিলাম এক বছর। এরপর যোগাযোগটা আরও বেড়ে গিয়েছিল ঢাকায় এসে। তো ওই এক বছরে সাদি’দার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। পরে তাদের পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। সাদি’দা বলতেন, ‘শোন তোর যখনই মন খারাপ হবে চলে আসবি আমাদের বাসায়। এই বাসাটা তোর নিজের বাসা মনে করবি।’
ধীরে ধীরে সাদি’দার পুরো পরিবারের সঙ্গে মিশে গেলাম। উনাদের পরিবারের মানুষজন এত আপন। আর ওই পরিবারে বা ওই বাসায় গেলে মনে হয় একটা প্রাণ আছে। সাদি’দাও পুরো মা-কেন্দ্রিক, মায়ের ওপর ভীষণ নির্ভরশীল। আবার অন্যদিকে তার বোনের ছেলেমেয়েরাও মামা অন্তপ্রাণ। ওই বাসায় গেলেই দেখতে পেতাম সবাই মামা মামা করছে। সাদি’দাকে ভীষণ ভালোবাসে সবাই। শুধু তার বাসার লোক না, সারা দেশের অজস্র মানুষ সাদি’দাকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। সাদি’দার মধ্যে অদ্ভুত এক সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। যেটা যে কাউকে সহজেই আকর্ষণ করে নেয়। তিনি মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। অথচ এই মানুষটা চলে গেলেন। এইভাবে কেন গেলেন শুধু সেটাই ভাবছি। তিনি কি কোনো অভিমানে চলে গেলেন? নাকি কোনো প্রতিবাদে? কীসের প্রতিবাদ করলেন? তিনি একবারও ভাবলেন না নিজেকে নিয়ে। তাকে যারা ভালোবাসত, তাদের কথাও ভাবলেন না?
গত অক্টোবরে আমন্ত্রণ পেলাম, শান্তিনিকেতনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী হবে। আমন্ত্রণ পেয়েছি আমরা তিনজন। বন্যা আপা, সাদি’দা আর আমি। আমি আর বন্যা আপা তো যাবই। কিন্তু সাদী’দা যাবেন না। তার হাঁটুতে অস্ত্রপচার হয়েছিল। বললাম, ‘সাদি’দা তোমাকে যেতেই হবে।’ বললেন, ‘আমি কীভাবে যাব, আমি তো হাঁটতেই পারছি না।’ আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তোমাকে হাঁটতে হবে না। বিমানবন্দরে আমি হুইল চেয়ারে নিয়ে যাব।’ সাদি’দা অবশেষে আমাদের সঙ্গে গেলেন। আমরা অনেক আনন্দ করলাম। শান্তিনিকেতনের পাশে সোনাইঝুড়ি হাটে গেলাম। সাদি’দা অনেক কিছু কিনলেন। বললেন, ‘আচ্ছা লিলি বলতো এই ফতুয়াটা কেমন লাগবে শিবলীকে? আচ্ছা লিলি বলতো এটা কেমন লাগবে ওর জন্য, এটা কেমন লাগবে?’ কত কিছু যে সাদি’দা কিনল। ওই যে বললাম তিনি ভীষণ ভালোবাসেন পরিবারের লোকজনদের।
সাদি’দার এই চলে যাওয়া কোনোভাবেই মানতে পারছে না। মানতে পারছে না শান্তিনিকেতন। আমরা যখন শান্তিনিকেতনে গেলাম, তখন খবর পেয়ে তার এক বন্ধু দুর্গাপুর থেকে চলে এলেন। সেখানে তিনি মেয়র। কত ব্যস্ত। কিন্তু সাদি’দাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তিনি সব ব্যস্ততা ফেলে চলে এলেন। আমরা সারা দিনরাত আনন্দ করলাম।
সাদি’দাকে অনেকেই ভালোবাসে- এটা যেমন ধ্রুব সত্য তেমনি তাকে অনেকেই আঘাত করেছে এটাও সত্য। তবে সাদী’দার মন ভীষণ নরম, শিশুদের মতো। তিনি সহজেই সবাইকে ক্ষমা করে দিতেন। ভুলে যেতেন। সাদী’দা অনেক কথাই শেয়ার করতেন। হৃদয়ে আঘাত পেলেও বলতেন। আমি জানতাম। আবার সেই ভীষণ ক্ষমতাও দেখতাম।
সকালে (বৃহস্পতিবার) চ্যানেল আইতে সাদি’দার স্মৃতিচারণে গান গাইলাম আমি ও ফাহিম হোসেন চৌধুরী। ফাহিম দুইটি গান গেয়ে বললেন এ দুটো সাদি ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছেন তিনি। সাদি ভাইয়ের কাছ থেকে এ দেশের অনেকেই গান শিখেছেন। ফাহিম কী সুন্দর করে বললেন, ‘আমি সাদি ভাইয়ের কাছে গিয়েছি, তাকে বলেছিলাম গান শিখব, এ দুটো গান আমাকে শিখিয়ে দিলেন। সাদি’দা সবার জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। এমন বড় হৃদয়ের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। সেই সাদি’দা কী এমন অভিমানে চলে গেলেন, আমি জানি না।’