‘আমি থাকব মাটির ঘরে, আমার চোক্ষে বৃষ্টি পরে’

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সুবীর নন্দী

সুবীর নন্দী

যেমন প্রত্যাশা তিনি করেছিলেন প্রিয় গানের কথামালায়, জীবনের অবসানে তেমনই হলো অবশেষে। চিরদিনের মতো চলে গেলেন তিনি অদেখা-অতল গভীর ঠিকানায়। তার মৃত্যুর সংবাদে তারই কণ্ঠ যেন কানে বাজছে: ‘ও আমার উড়ালপঙ্খীরে/যা যা তুই উড়াল দিয়া যা/আমি থাকব মাটির ঘরে/আমার চোক্ষে বৃষ্টি পরে…।’

দূর প্রবাসের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে এই শিল্পী বুধবার (৮ মে) নিথর দেহে স্বদেশে ফিরে আসছেন। গানের উড়াল পঙ্খী হয়ে তিনি আসছেন জন্মভূমির প্রিয় মাটির ঘরে, চোখে নিয়ে বৃষ্টির বেদনাদীর্ণ অশ্রুমালা।

বিজ্ঞাপন

সত্তরের শেষে আশির দশকের সূচনায় সুদূর বৃহত্তর সিলেট থেকে এক কণ্ঠশিল্পী দুরুদুরু বক্ষে বাংলাদেশের সংগীত জগতে স্থান পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তখন নিজেকে প্রকাশ করার এতো মিডিয়া ছিল না। ‘সবে ধন নীলমণি’র মতো ডিআইটি ভবনের ছোট্ট পরিসর থেকে রামপুরার নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত ‘বিটিভি’ ছিল একমাত্র মাধ্যম আর ছিল বাংলাদেশ বেতার।

বিজ্ঞাপন

‘বিটিভি’ তখন সারা দিনের চ্যানেল নয়। বিকেল-সন্ধ্যার আয়োজন। যাতে খবর, কার্টুন, ইংরেজি সিরিয়াল, নাটক ইত্যাদির পর গানের খুব একটা সুযোগ ছিল না। মাসে বা সপ্তাহে গানের প্রোগ্রাম হয়েছে, তাতে ঢাকার নামজাদা বা কর্তৃপক্ষের খাতিরের তথাকথিত শিল্পীদের ঠেলে নতুন কেউ জায়গা পেতো না সহজে।

এমন বিরূপতার মুখোমুখি হয়েও সিলেটের নবাগত শিল্পী মোটেও দমে গেলেন না। মফস্বলের সীমাবদ্ধ অতীত থেকে রাজধানীতে নিজের বৃহত্তর বর্তমান নির্মাণ করলেন। দিনে দিনে পুরো বাংলাদেশ, এমনকি, বৈশ্বিক বাঙালির সুপরিচিতি, প্রিয় শিল্পী হলেন তিনি। তিনিই সুবীর নন্দী।
https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/May/07/1557241713187.jpg

সুবীর নন্দীর ষাটোর্ধ বছরের জীবনের ৫০ বছরই কেটেছে গান নিয়ে। সুদীর্ঘ শিল্পী জীবনের ইতিহাসে তিনি প্রায় আড়াই হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার সংগীত জীবন আসলে একজন শিল্পীর লড়াইয়ের কাহিনী। নিজেকে শিল্প ও সংগীতের ঈর্ষণীয় জায়গায় উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে সুবীর নন্দী তার লড়াই থেকে এক মুহূর্তের জন্য সরে আসেননি। যে কারণে শূন্য থেকে শুরু করলেও জীবনের পরিণতিতে তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হয়েছেন।

সিনেমা ও অ্যালবামে যে বিপুল গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন, সেসবের অনেকগুলোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার কিছু গান তো জনপ্রিয়তায় তুঙ্গস্পর্শী হয়েছে। সুবীর নন্দীর সেরা ১০ গান শিরোনামে বার্তা২৪.কমের ভিডিও কনটেন্টে সে ছোঁয়া রয়েছে।

কিন্তু কেন তার জনপ্রিয়তা? গানের কথা ও সুরের জন্য তো বটেই। এবং সুবীর নন্দীর দুঃখজাগানিয়া গায়কীর জন্যও। তার গানে অভ্রভেদী আর্তনাদ ছিল না। দুঃখের তীব্র মর্মবেদনা ছিল না। ছিল পরিশীলিত কণ্ঠে ব্যাথার জাগরণ। বুকের মাঝখানে মৃদু টোকা দিয়ে যাওয়া শিশিরের টুপটাপ শব্দের মতো বেদনারা সুবীরের গলায় খেলা করেছে।

বৃহত্তর সিলেটের যে অপরূপ রহস্যময়তা ও মায়াজাদুর পরশ নিয়ে সুবীর নন্দী বাংলাদেশের গানের জগতে এসেছিলেন, তাকে আরও ঋদ্ধ করেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূনের চলচ্চিত্র ও নাটকে বৃহত্তর সিলেট-ময়মনসিংহের হাওর পরিবেষ্টিত ভাটিবাংলার যে মায়াবী সুর উচ্চারিত হয়েছে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ভর করে, তা বাংলা গানের অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পী সুবীর নন্দীকে পরিণত করেছে শাশ্বত বাংলার চিরায়ত গায়কে। অনাদি বাংলার সংগীত পরম্পরায় যে গায়ক নীলপাখির প্রতীকে গেয়ে যাবেন বেদনার ধ্বনি।