ডায়রিয়ায় আতঙ্ক নয় চাই বিশেষ সতর্কতা

  • সেলিনা আক্তার
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। আমরা সাধারণত ‘ডায়রিয়া’ও ‘পাতলা পায়খানা’ শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করি। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় পায়খানা নরম বা পাতলা হওয়া মানেই যে ডায়রিয়া হয়েছে, এমনটি নয়। সারাদিনে তিনবার বা তার বেশি নরম বা পাতলা পায়খানা হলে তাকেই সাধারণত ডায়রিয়া বলা হয়। এছাড়া কারও যদি স্বাভাবিকের তুলনায় ঘনঘন পাতলা পায়খানা হয় সেটাকেও ডায়রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। যে শিশুরা বুকের দুধ পান করে, তাদের পায়খানা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা নরম আর আঠালো হয়। সেটা ডায়রিয়া নয়।

যে-কোনো সময় মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। সব বয়সের মানুষের ডায়রিয়া হতে পারে, গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, সর্দিজ্বরের মতো মৌসুমি রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছরই গরমকালে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। এই বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে এবং মার্চের মাঝামাঝি থেকে বেশ ব্যাপকহারে তা বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণত প্রতিবছর এর প্রকোপ শুরু হয় এপ্রিলের শুরু থেকে এবং ছয় থেকে আট সপ্তাহ তা চলতে থাকে। কিন্তু এই বছর ডায়রিয়া যে শুধু আগেভাগেই শুরু হয়েছে তাই নয়, রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ডায়রিয়া এখন কিছুটা কমে আসছে।

বিজ্ঞাপন

ডায়রিয়া সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ভালো হয়ে যায় তবে ডায়রিয়া থেকে যদি মারাত্মক পানিশূন্যতা হয়, তবে তা মৃত্যুর কারণও হতে পারে।  ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন লবণ বেরিয়ে যায়। যখন এই ঘাটতি পূরণ করা হয় না, তখনই পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই ডায়রিয়ার প্রথম চিকিৎসা হলো পানিশূন্যতা পূরণ করা। পানিশূন্যতার প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে—মুখ শুকিয়ে আসা; পিপাসা লাগা ;চোখ শুকনো লাগা বা খচখচ করা ;গাঢ়, তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া ও প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া। ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট পানিশূন্যতার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে ডায়রিয়ার কিছু গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পেলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে দ্রুত যেতে হবে। লক্ষণগুলো হলো পায়খানার সাথে রক্ত বা আঠালো মিউকাস যাওয়া;প্রচণ্ড পেটব্যথা; ডায়রিয়ার অবস্থার উন্নতি না হওয়া; পানিশূন্যতা পূরণ না হওয়া; ডায়রিয়ার সাথে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জ্বর, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি থাকা এগুলো গুরুতর অবস্থা নির্দেশ করে, তাই ঘরোয়া চিকিৎসার সাথে সাথে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

ডায়রিয়া হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে বসেই চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেমন — খাবার স্যালাইন: সাধারণত প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর এক প্যাকেট বা আধা লিটার করে খাবার স্যালাইন খেতে হবে। এছাড়া চিড়ার পানি, ভাতের মাড় কিংবা ডাবের পানিও খাওয়া যেতে পারে। ডায়রিয়ার ওষুধের সাথে পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে। পুষ্টিহীনতা থেকে ডায়রিয়া হয়। আবার ডায়রিয়ার কারণে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাই ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের বুকের দুধ এবং বয়স্কদের স্বাভাবিক খাবার খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, মারাত্মক পানিশূন্যতা হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা বিভাগে গত তিন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৬, চট্টগ্রামে ৫১ হাজার ৫৯৬, রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৬০৩, রংপুরে ৩৪ হাজার ৮১৯, খুলনায় ১ লাখ ১ হাজার ৮১৯, বরিশালে ১১ হাজার ৪০৩ এবং সিলেট বিভাগে ৩২ হাজার ৯৩৮ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

দেশে হঠাৎ ডায়রিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বাড়ার পেছনে পানিদূষণকে দায়ী হরা হচ্ছে পাশাপাশি পরিবেশদূষণও দায়ী। তাই স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে দেশের পানি, বায়ু ও মাটিকে ভালো রাখতে হবে। বাংলাদেশে ৯৮.৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানি পান করে এবং ৮১.৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহার করে। তারপরও ডায়রিয়ার প্রকোপ রয়েই গেছে।

ঢাকা মহানগরে যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের বসিলা ও টঙ্গী এলাকাকে ডায়রিয়ার হটস্পট হিসেবে চিহৃত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব এলাকায় সাধারণত নিম্নবিত্তের সংখ্যা বেশি। হটস্পটগুলোতে ওয়াসার নজরদারি রাখতে হবে বিশেষ করে বর্ষার আগে এবং পরে পানি দূষণ বাড়ছে কিনা। দূষণ যদি বাড়ে তাহলে এসব স্থানে আপদকালীন পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

-২-

ডায়রিয়া থেকে বাঁচার জন্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, বাইরের খোলা পানি খাওয়া যাবে না অবশ্যই সম্পূর্ণ নিরাপদ ও ফুটানো পানি পান করতে হবে। বাইরের খাবারের ব্যাপারেও খুব‌ই সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরিবেশন করা হয় এমন খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। রাস্তার পাশে এই সময় অনেক খোলা পরিবেশে লেবুর শরবত, আখের রস, জুস বা ফল কেটে বিক্রি করা হয় এগুলো কোনোভাবে পান করা যাবে না। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়রিয়া হলে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে।  প্রথমে ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে দিনে আট থেকে ১০ গ্লাস তরল খাবেন। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়ার পর এক কাপ পরিমাণে তরল খাবার খাওয়া উচিত। ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন’-এর তথ্যানুযায়ী ডায়রিয়া হলে উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত খাবার যেমন–কলা, আলু ও ফলের রস খাওয়া যাবে। পিনাট বাটার, চমড়াছাড়া মুরগি বা টার্কিও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণকরে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়, প্রসাবের পরিমাণ কমে যায়, অতিরিক্ত পানি পিপাসা লাগে, মুখ শুকিয়ে যায় এবং শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

 সরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্হ্যসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন, আইভিফ্লুইড স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সরবরাহ রয়েছে।

পরিবারে ডায়রিয়ার বিস্তার রোধে যা যা করতে হবে তা হলো-পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হলে রোগীর পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এটি একদিকে রোগীকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে, অন্যদিকে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়রিয়া সেরে যাওয়ার পরেও কমপক্ষে দুই দিন কর্মক্ষেত্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো যাবে না । তানাহলে অন্যদের মাঝেও ডায়রিয়া ছড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়াও বারবার সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। পায়খানা কিংবা বমির সংস্পর্শে এসেছে এমন কাপড় বা বিছানার চাদর গরম পানি দিয়ে আলাদাভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। পানির কল, দরজার হাতল, টয়লেট সিট, ফ্লাশের হাতল, জীবাণুর সংস্পর্শে আসতে পারে এমন জায়গা প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্থ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই ডায়রিয়া প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা আবশ্যিক। আর এক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে নিজে সচেতন হোন আশে পাশের লোকজনকে সচেতন করুন।