যখনই পশ্চিম আকাশ হয়ে নিদ্রায় যেতে চায় সূর্যিমামা ঠিক তখনই নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় শ্বেত মেঘের ভেলা। শরতের সৌন্দর্যের উপমায় থাকে সাদা আকাশ আর শ্বেত রঙে মুগ্ধতা ছড়ানো কাশফুল। চারপাশে হতে দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে মনে ফেরাচ্ছে সতেজতা। এ মনোরম প্রকৃতি অন্তরের গভীরাংশে নাড়া দেয়।
বর্ষার গুড়গুড় শব্দের দিনের শেষে আসে শরৎ। শরতের সাদা-শুভ্রতা নিয়ে দিগন্ত জুড়ে চোখ ধাঁধানো কাশফুলের সমাহার। শ্বেত শুভ্রতার কাশফুলের হাতছানিতে বিমোহিত দর্শনার্থীরা। পথে-প্রান্তরে দেখা মিলে কাশফুলের। কাশফুলের অভয়ারণ্যে মন মিশে একাকার হয়ে ওঠে। জেগে ওঠে প্রাণ।
বিজ্ঞাপন
এরকম দৃশ্য চোখে পড়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলা সদর পুষ্টকুমারী চড়পাড়া সড়কের দক্ষিণ পাশে।
দেখা যায়, শুধু কাশবনে গিয়ে কাশফুল দেখা নয় বরং কাশফুলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ছে প্রকৃতিপ্রেমী বহু মানুষ। দর্শনার্থীরা নিজে শুধু এ নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করেন না। তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কাশফুলের সাথে ছবি তুলছেন। সাদা কাশফুলের মন মাতানো দোল খাওয়া শীষ দেখতে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন বিকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মহাসড়কের পাশে কাশফুল থাকায় দর্শনার্থীরা আসতেও সুবিধা হচ্ছে। কাশফুলের শুভ্রতার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের স্বাক্ষী হতে নিজেরা ছবির ফ্রেমে বন্দী হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
ঘুরতে আসা লিজা আক্তার বলেন, কাশফুল দেখে মনটা ভরে গেছে। বান্ধবীদের সাথে করে নিয়ে এসেছি। বিকেল বেলার সময়টা ভালোই লাগছে। অনেকেই নিজেদের ভঙ্গিমায় ছবি তুলছেন। দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসেছে। তারাও তাদের মোবাইল দিয়ে নিজেদের ছবি তুলছেণ। ছবি তুলতেই ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ঘুরতে আসা রাকিব হাসান বলেন, বিকেলের বাতাস যেন শীতের আগমনের বার্তা দিচ্ছে। কাশফুলের সমারোহে শৈশবের স্মৃতিগুলোকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এই অপরূপ সৌন্দর্যের কাছে থাকতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।
কলেজ পড়ুয়া সাব্বির মিয়া বলেন, ঘুরতে কার না ভালো লাগে, আর যদি চোখের সামনে কাশফুল থাকে তাহলে তো কথায় নেই। আর এই সৌন্দর্য উপভোগ করতেই এখানে আসা। কাশফুল জানিয়ে দিচ্ছে শরৎকালের উপস্থিতি। কাশফুল তার অপরূপ সৌন্দর্য ডানা মেলে ছড়াচ্ছে।
পুকুরপাড়া গ্রামটিতে স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই এখনো পাহাড়ি নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা যা বৈদ্য বা ঋষির চিকিৎসা হিসেবে পরিচিত, তার উপর নির্ভরশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শহরমুখী চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। যদিও পুরো এলাকায় স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি না থাকার কারণে কখনো কখনো মুমূর্ষু রোগীকে পাশের রুমা উপজেলা সদরে একদিনের হাঁটা পথে সবাই মিলে বহন করে নিয়ে যায়।
এলাকাটি অতি দূর্গম হওয়ায় স্বাস্থ্য কর্মী বা ওষুধপত্র পৌঁছাতে সময় লাগে। অনেক সময় এলাকাবাসী প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্প অথবা বিজিবি ক্যাম্প এর উপর নির্ভরশীল হয়। এই এলাকার নারীরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার মুখোমুখি হয়। মাসিক বা পিরিয়ডের সময় পর্যাপ্ত সচেতনতা এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের অভাব ও ব্যবহার বিষয়ে অজ্ঞতা থাকায় এখানকার কোনো নারীই এসব ব্যবহার করেনা বরং যে যার সক্ষমতা অনুযায়ী নিজেদের মতো করে সবাই নিয়ন্ত্রণ করে।
সুপেয় পানির অভাব পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কমবেশি সব গ্রামের একটি প্রধান সমস্যা। পানির জন্য আদিবাসীরা ঝিরি-ঝর্ণার উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু ঝিরি বা ঝর্ণায় পানিও সবসময় থাকেনা। বছরের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসে ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যায়। ফলে এলাকার জনগোষ্ঠীদের এসময় নিরাপদ পানির জন্য তীব্র কষ্ট করতে হয়। পানি পাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে আধ-ঘন্টা বা এক ঘন্টা দূরের রাস্ত হেঁটে, লাইন ধরে অনেক অপেক্ষার পর পানি আহরণ করতে হয়। পানি সংগ্রহের এই কাজটি সাধারণত: নারীরাই করে থাকেন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি থাকায় অনেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ফুটিয়ে তুলে রাখেন খাবার পানি হিসেবে। আবার এসময় ঝর্ণায় পানি থাকায় পানির কষ্ট কিছুটা কম থাকে। গ্রীষ্মকালে পানি সমস্যার কারণে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
এখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা জাতীয় রাজনীতি দ্বারা তেমন প্রভাবিত নয়। যেহেতু গ্রামটি পার্বত্য চট্টগ্রামের অতি দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এবং আšতর্জাতিক সীমানা ভারত, মিয়ানমারের সংযোগস্থল (যেটি ত্রিসীমানা বলে অভিহিত) সেহেতু এখানকার রাজনৈতিক চরিত্র আঞ্চলিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত। এই এলাকাটি যুগ যুগ ধরে দেশীয় এবং আšতঃদেশীয় নানা বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রকাশ্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আরও পড়ুন: ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো জীবন নয় যাদের
এই এলাকা মিজো পার্টি (মিজোরামের গৃহযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিদ্রোহী সশস্ত্র দল), আরাকান আর্মি (এএ), আরাকান লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী দল, মগ পার্টি সবশেষে কুকি-চিন ন্যাশলাল ফ্রন্টের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এসকল পার্টি গুলো নানান সময়ে এলাকাগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেক নিরীহ গ্রামবাসী তাদের এই অবস্থানের কারণে নিরব অত্যাচারের শিকার, আবার অনেকে তাদের সুবিধাভোগী।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দলের প্রভাব কমে গেছে। যদিও পুরোপুরি সশস্ত্র দল মুক্ত এলাকা হতে পারেনি। এখানকার দূর্গম জঙ্গল সশস্ত্র দলগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে সুপরিচিত। তবে যেসব স্থানে সেনা/বিজিবি ক্যাম্পের অবস্থান, সেখানে তাদের পদচারণা তেমন নেই। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্যি যে সেনা ক্যাম্পগুলো নিরাপত্তার ভূমিকায় থাকে বলে ক্যাম্পের আশেপাশের আদিবাসী গ্রামগুলো নিরাপদবোধ করে।
২০১৫ সালে নতুন এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত আতুমং মার্মা। আতুমং মার্মা ৪ নং বড়থলি ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলেও বাস করেন বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা সদরে। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে অস্থায়ী ইউনিয়ন অফিসও রুমাতেই করেন। তার অধীনস্ত এলাকা দূর্গম হওয়ায় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে বছরে দুই তিনবার এলাকা পরিদর্শনে যান। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে এই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সমস্ত সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই করে থাকে।
সেনাক্যাম্পগুলো প্রায় নয় দশটি গ্রাম কেন্দ্র করে গঠিত হয়। এই এলাকার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি চার পাঁচটি সেনাক্যাম্প এবং বিজিবি ক্যাম্পই দেখশোনা করে থাকে। সব গ্রামে না থাকলেও কয়েকটি সচেতন গ্রামে, গ্রামের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা এবং একতা বজায় রাখার জন্য কমিউনিটি ক্লাব রয়েছে। ক্লাবগুলো শিক্ষার্থী এবং গ্রামের অভিভাবকদের মধ্যকার সুসম্পর্ক তৈরি ও গ্রামের ভেতর যেকোনো ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
জীবনমান উন্নয়নে যা করণীয়
পুকুরপাড়া এলাকার প্রাত্যহিক দিনের এই চিত্রসমূহ আসলে দূর্গত পার্বত্য এলাকার ত্রিপুরা, মারমা কিংবা বম জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনকেই নির্দেশ করে। প্রশ্ন হলো যদি এই অতি দূরবর্তী জনগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আবাসস্থল ঠিক রেখে জীবনধারার মানোন্নয়ন করতে চান, সেটা আসলে কীভাবে সম্ভব? পুকুরপাড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের দেখায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের আদিবাসী জীবনের উন্নয়নের প্রথম শর্ত। কেননা তাদের অধিকাংশই শহরাঞ্চল থেকে দূরবর্তী স্থানে বাস করেন। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও পর্যটনক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন করাও অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে তারা কতটা উন্নয়নসহযোগীদের তাদের এলাকায় প্রবেশাধিকার দেবেন সেটাও তাদের সিদ্ধান্তের উপর ন্যস্ত করা শ্রেয়।
পাহাড়ি বা সমতলীয় যেকোন আদিবাসীদের সাথে যুক্ত হবার সময় এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যেন তা এই প্রান্তিক দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার, স্বায়ত্ত্বশাসন এবং সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেয় । এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব যা আসলে এখনও সীমিত আকারেই রয়েছে, উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি সত্ত্বেও, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বা¯তবায়নে আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন বাংলাদেশে এখনও অনেক কম। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের আদিবাসী নেতা, প্রবীণ এবং যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করা উচিত।
আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং অভিজ্ঞতাকে আমরা অতি সরলীকরণ বা স্টেরিওটাইপ করে উপস্থাপন করে ফেলি। যেনো বা সকল জনগোষ্ঠীর সমস্যাই একরকম। এ হ্রাসমূলক আখ্যান এড়িয়ে চলা উচিত। তাদের সমস্যাগুলো যেহেতু তাদের নিজ নিজ অঞ্চল এবং প্রেক্ষাপট অনুসারে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়, কাজেই অবকাঠামোগত ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকে স্থানিক প্রেক্ষাপটে সাজানো জরুরি। এছাড়াও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মতো অবিরাম সংগ্রামগুলো চিহ্ণিত করা উচিত এবং তাদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়া দরকার। একই সঙ্গে যেকোন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জড়িত করতে হবে।
আদিবাসীদের অংশগ্রহণে উপদেষ্টা বোর্ড বা স্টিয়ারিং কমিটি তৈরি করতে হবে। নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে আদিবাসী কণ্ঠ, আদিবাসী সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান রক্ষকদের নেতৃত্ব এবং দক্ষতার উপর জোর দিতে হবে। আদিবাসী ভাষাচর্চা বিশেষভাবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্ব-স্ব জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপাদান অšতর্ভূক্তকরণের ব্যবস্খা করতে হবে। মোটকথা, পার্বত্যচট্টগ্রামে ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে তাদের মূল আবাসস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। বাংলাদেশের এসব জনগোষ্ঠী পাহাড়ী বনাঞ্চল প্রতিবেশের সাথে সহাবস্থান করছেন। বন তাদের হাতেই নিরাপদ। বহুবর্ণিল ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে তারা বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে ঋদ্ধ করেছেন।
দূরবর্তী জনপদের এই অধিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে তাদের আবাসস্থল এবং সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রেখেই সব কিছু করতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশে বহুসংস্কৃতির অবস্থানকে সাবলীল করতে ও অতিদূর্গম অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার মানোন্নয়নে দেশের সরকার ও জনসাধারণের আন্তরিক অবস্থান প্রয়োজন। (সমাপ্ত)
ড. শাওলী মাহবুব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাগর ত্রিপুরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিজেনাস স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অতি দূর্গম এই এলাকায় অবস্থিত পুকুরপাড়া এবং আশপাশের অঞ্চলগুলো বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, অর্থনৈতিক সুবিধা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং সকল মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানকার প্রধান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যাবলি জুম চাষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ঘরবাড়িগুলো সাধারণত: পাহাড়ি উঁচু জায়গাতেই নির্মিত হয় এবং বেশিরভাগ ঘরবাড়ি বাঁশ, বেত, ছন এবং কাঠ দিয়ে পরিবেশ উপযোগী করে নির্মিত। ঘরবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে ম্রো, ত্রিপুরা, মার্মা, খেয়াং এবং খুমি সম্প্রদায় একই আদল অনুসরণ করে থাকে।
উপার্জনের জন্য এরা সবাই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল হলেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে বাগান চাষের উপরও ঝুঁকছেন। জুম চাষ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় হয়। যেমন- জানুয়ারি-মার্চ মাস হলো জুম কাটার সময়। এসময় কাঁচা জঙ্গলকে কেটে শুকানো হয় এরপর মার্চ-মে মাসে শুকানো জঙ্গলটিকে চাষের উপযোগী করার জন্য পোড়ানো হয়। পরবর্তীতে পোড়ানো জুমটিকে পরিস্কার করে মে-জুন মাসে এক বছরের জন্য ধান, ভুট্টা, তিল, হলুদ, কাকন চাল, মারফা (শশা) এবং অন্যান্য শাক সবজি রোপণ করা হয়। রোপণের পরবর্তী সময়ে ধান এবং অন্যান্য রোপণকৃত শস্যগুলোকে দ্রুত বৃদ্ধি করার জন্য ২/৩ বার পরিষ্কার করা হয় জুমকে। এরপর আগস্ট-অক্টোবর মাসে ধান কাটার মৌসুম চলে।
মূলত: এই সময়গুলোতে পাহাড়িরা জুমের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকে এবং জুমকেন্দ্রিক জীবন করে। গ্রাম ছেড়ে অনেকেই এসময় দূরে টং ঘরে (এটি একধরনের জুমে নির্মিত ঘর যা জুমে থাকাকালীন জুমিয়ারা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে) গিয়ে ২/১ মাস অথবা কয়েকদিনের জন্য থাকে, যাতে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারে এবং পশু-পাখির আক্রমণ থেকে জুমকে রক্ষা করতে পারে। শুকনো মৌসুমের জুমের উৎপাদিত ফসলাদি এবং অন্যান্য তরকারি পাহাড়িরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে বর্ষা এবং অন্যান্য ব্যস্ততম সময়ে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। দূর্গম হওয়ার কারণে বাজারে নিত্যপণ্য এই অঞ্চলের মানুষেরা মাসের এক দিন অথবা সপ্তাহের বাজারদিনে সংগ্রহ করে থাকে। গ্রামের লোকজন দলবেঁধে দু’একদিনের হাঁটা পথ অতিক্রম করে বাজার করতে যায়।
স্থানীয় বাজারে এসে সবাই পাহাড়িদের থাকার হোটেল, যেগুলোকে ত্রিপুরারা ‘বাঁদালী’ বলে, সেখানে অবস্থান করে। তবে স্থানীয় পাহাড়িদের এই হোটেলে থাকার চিত্রটি একটু আলাদা। শহরের আবাসিক বা অনাবাসিক হোটেলগুলোর বিপরীত চিত্র এখানে দেখা যায়। এসব স্থানীয় হোটেলে থাকতে হলে নিজ উদ্যোগেই পরিমাণমতো ভাগের চাল, (কেনা হোক বা বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হোক) হোটেল মালিকের কাছে জমা দিতে হয়।
তবে চালের পরিবর্তে চালের বাজারমূল্যের পরিমাণ টাকাও জমা দেয়া যায়। তরকারির জন্য স্থানীয় বাজারের মূল্য অনুসারে পেট প্রতি ৫০/৬০ টাকা মালিককে দিতে হয়। এভাবে আদিবাসীরা গ্রাম থেকে দিনে এসে বাজারে রাত্রি যাপন করে ভোরবেলা বা পরদিন সকালে সপ্তাহের বা মাসের বাজার করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যেসব পণ্য জুম থেকে উৎপন্ন হয় না অথবা নিজেরা উৎপাদন করতে পারেনা সেগুলোই পাহাড়িরা বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায়।
বাজার থেকে তারা লবণ, নাপ্পি (শিদোল)/শুটকি, তেল, সাবান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে থাকে। অপরদিকে বিক্রি করার জন্য জুমজাত কৃষি পণ্য তারা বাজারে নিয়ে যায়। জুম চাষের উপর অতিনির্ভরতার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ততো উন্নত নয়। তবে যারা গবাদিপশু যেমন-গরু, গয়াল, ছাগল, শুকর ইত্যাদি পালন করে থাকেন তাদের অর্থনৈতিক দিক বেশ ভালো। গরু বা গয়াল বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জঙ্গলে ছেড়ে দিলে নিজেদের মতো করে খাবার গ্রহণ করে। কোন নির্দিষ্ট প্রয়োজনে মালিক জঙ্গল থেকে এগুলোকে ধরে এনে বিক্রি করে। যাদের গরু অথবা গয়াল আছে তাঁরাই মূলত সন্তানদের শহরে পড়ালেখা করাতে সক্ষম।
জুম চাষের মাধ্যমে আয়কৃত টাকা সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য খরচ যথেষ্ট না হওয়ায় অনেকেই সšতানদের শহরে পড়ালেখা করার জন্য পাঠাতে পারেন না। আবার অনেক পিতামাতার সচেতনতার অভাবে শহরে এসে শিক্ষার্থীরা ৭ম, ৮ম ও ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর ঝরে পড়ে। কিন্তু এরা পরবর্তীতে গ্রামে এসেও জুম চাষে মনোনিবেশ করতে পারেন না। ফলে তারা শহরে অভিবাসিত হয়ে পোশাক শিল্পে কাজ নেয়। কারণ পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শিক্ষাগত যোগ্যতার তেমন প্রয়োজন হয় না।
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে বান্দরবান সদরের জাদিপাড়ায় ফাতেমা রাণী গির্জা প্রতিষ্ঠিত হলে এর মাধ্যমে শিক্ষার প্রাথমিক প্রসার ঘটে। চার্চটি বান্দরবানের দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ প্রদানের জন্য হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করে। ফলে স্থানীয় মারমা, ত্রিপুরা, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো এবং অন্যান্য পাহাড়িদের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে চার্চের অধীনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং নামমাত্র বেতনে গ্রামের বেকার যুবক-যুবতীদের শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। এছাড়াও বড়থলিসহ বিলাইছড়ি সংলগ্ন বান্দরবানের অন্যান্য উপজেলা যেমন থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, আলিকদম, লামা ইত্যাদি জায়গাগুলোতে চার্চের অধীনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা-প্রদান করা হয়।
পাশাপাশি যে গ্রামগুলো বাংলাদেশ আর্মি ক্যাম্পের অধীন, সেগুলোতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নামমাত্র বেতনে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। দূর্গম অঞ্চলগুলোতে ত্রিপুরা, বম, মারমা, খুমি এবং খেয়াংদের মধ্যে যেসব পিতামাতা শিক্ষা সচেতন তাঁরা তাদের সন্তানদের স্থানীয় চার্চ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণিতে পড়িয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বা বরিশাল জেলা শহরে শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তারা বিনামূল্যে বা কম দামে অথবা পরিচিত অনাথালয় ও আশ্রম ইত্যাদি স্থানে স্বল্প খরচে থাকতে পারে। এভাবেই এখানকার বেশিরভাগ শিশুরা ছোটবেলা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজের গ্রাম পরিবার ছেড়ে শহরে আসে।
বিলাইছড়ি উপজেলার সাক্ষরতার হার ২৬.৭০% এবং এ উপজেলায় ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা থাকলেও, ২০১৫ সালে বড়থলি ইউনিয়নে নতুন ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হওয়ার পরও কোনো সরকারি-বেসরকারি (মিশন পরিচালিত প্রাইমারি স্কুল বাদে) প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া সরকারি স্কুল না থাকার কারণে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে গ্রামের ছেলেমেয়েদের সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
উপজেলা সদর বিলাইছড়ি হলেও পুকুরপাড়া থেকে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে যেতে হাঁটা পথে কম করে হলেও ৭ দিন লাগে। এর চাইতে পার্শ্ববর্তী বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা পুকুরপাড়া এলাকা থেকে কাছে এবং তা মাত্র এক দিনের হাঁটা পথ। একারণে পরীক্ষার্থীরা বিলাইছড়িতে অবস্থিত স্কুলগুলোর পরিবর্তে রুমা উপজেলাতে সমাপনী স্কুল পরীক্ষা দেয়।
এপর্যন্ত পুকুরপাড়া থেকে এবং এই বড়থলি ইউনিয়ন থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন দুই জন, স্নাতকে অধ্যয়নরত রয়েছেন পাঁচ জন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন দুই জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, সরকারি মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ছেন একজন এবং নার্সিংয়ে দুইজন পড়ােেশানা করছেন। অনেক গ্রামে এখনও এসএসসি বা এইচএসসি পড়ুয়া শিক্ষার্থী নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও দূর্গম কারণে এলাকায় কোন সরকারি প্রাথমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই । (চলবে...)
প্রচণ্ড তাপদাহের পর অবশেষে ইতি টানতে যাচ্ছে ভাদ্রমাস। তবে শেষদিকে এসে টানা বৃষ্টিতে অসহ্য গরমের ক্লান্তি যেন নিমিষেই হারিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টি, বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পাস, অল্প একটু ফোন চার্জের জন্য ছুটাছুটি, ক্যাম্পাস জুড়ে খাবার সংকট। এই সবকিছুকে পিছনে ফেলে প্রকৃতি যেনো তার অপরূপ সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছে বৃষ্টি স্নানের মাধ্যমে। দিনভর কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটাছুটি, প্রেমিক যুগলের বৃষ্টি বিলাস, চায়ের দোকানের আড্ডা সাথে স্নিগ্ধ আবহাওয়া যেনো নতুন করে ক্যাম্পাসের প্রাণের সঞ্চার করে। বলছিলাম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রকৃতি ঘেরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বৃষ্টিস্নাত দিনের কথা।
বৃষ্টি যেন এক অপরূপ মোহের জন্ম দেয় শিক্ষার্থী মনে। ক্যাম্পাসের পিচঢালা রাস্তায় বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন বর্ষার উপস্থিতি জানান দেয়। বৃষ্টির পরশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পায়, ফিরে পায় নিজের সজীব অস্তিত্ব। ব্যস্ত ক্যাম্পাসে হঠাৎ বৃষ্টি এনে দেয় এক গভীর নীরবতা। ডায়না চত্বর, বটতলা, পাই চত্বর, টিএসসি, প্যারাডাইস রোডসহ পুরো ক্যাম্পাস ফিরে পায় তার সজীবতা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করা, এক ছাতার নিচে দুই তিনজনের হেঁটে যাওয়া কিংবা প্রেমিক যুগলের বৃষ্টি বিলাস সবমিলিয়ে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি।
সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে দেশব্যাপী নেমেছে বৃষ্টির ধারা। গত সোমবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড গরম পড়তে শুরু করে। দেশের অন্তত ২০টি জেলায় বয়ে যায় তাপপ্রবাহ যা বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে যশোর ও খুলনা অঞ্চলে অবস্থানের পর থেকেই উক্ত অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়। যার প্রভাবে বৃষ্টি নেমেছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও।
ঝড়বৃষ্টির কারণে বিদ্যুৎ না থাকলেও হলের বেশ কয়জন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় রুমে বসে অনলাইনে ক্লাস করতে। আবার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়ামোড়ে চায়ের টঙে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে। রাত থেকে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে যেয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে মোবাইল চার্জ দিতে। আবার একদল শিক্ষার্থীকে দেখা যায় ঝুমঝুম বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল মাঠে ফুটবল খেলতে। তবে ক্যাম্পাসে চলমান এতকিছুর মধ্যেও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায় রুমে শুয়ে আরামের ঘুম ঘুমাতে। তাদের কাছে বৃষ্টির দিনের ঘুমটাই যেন সবকিছু।
ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা যায় বেশ কিছু চিত্রের। বঙ্গবন্ধু হলের পুকুরে পাওয়া যায় একদল শিক্ষার্থীকে সাঁতার কাটতে। জিগ্যেস করলে বলেন, ছোটবেলায় বাড়ির পাশের পুকুরে লাফালাফি করতাম। এবারের বর্ষায় পুকুরে বেশ পানি হয়েছে। তাই ছোটবেলার মতো সাঁতার কাটার লোভ সামলাতে পারলাম না। পশ্চিম পাড়ার রাস্তাটা প্রেমিক যুগলদের জন্য। এই ক্যাম্পাসের অন্যান্য জায়গার চেয়ে এই রাস্তাকেই তারা আপন করে নেয়। আর যদি হয় বৃষ্টিস্নাত দিন তাহলে তো কিছু বলারই অপেক্ষা রাখেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অফিস, চিকিৎসাকেন্দ্র, মফিজ লেক এবং প্রতিটি রাস্তার দুপাশে থাকা ফুল ও পাতাবাহার গাছের পাতা গুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ্ হলের শিক্ষার্থী জাহিদ বলেন, কৈশোরে বৃষ্টিতে ভেজার কথা খুব মনে পড়ে। কবে বৃষ্টি হবে, আকাশ পানে চেয়ে দিন গুনতাম শুধু বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। মায়ের বকুনি, বিজলি চমকানির ভয়, কিছুই ফেরাতে পারেনি বৃষ্টিতে ভেজা থেকে। তবে ক্যাম্পাসে এসে আর সেভাবে বৃষ্টিবিলাস করা হয়না। ক্লাস-পরীক্ষার চাপে অনেকটা যান্ত্রিক জীবন কাটাই। তাই বৃষ্টির দিন পেলে খুবই ভালো লাগে। অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভেজা, কাকভেজা হয়ে ক্যাম্পাসের সমগ্র এলাকা ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন বলেন, কর্মব্যস্ত ক্যাম্পাসের ক্লাস, পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের মতো ধরাবাধা একাডেমিক কাজ থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা বোধ হয় একটু বৃষ্টির দিনের অপেক্ষায় থাকে। আমাদের ক্যাম্পাসে গাছপালা পরিমাণ বেশ ভালো। হল থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ক্যাম্পাসে ঘুরতে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে খুবই ভালো লাগে। বৃষ্টির মধ্যে টঙের চা পানের অনুভূতিটাও অসাধারণ। বৃষ্টিস্নাত ক্যাম্পাস নিজে যেমন সজীব হয়েছে, তেমনি আমার মনকেও সজিব এবং প্রাণবন্ত করেছে।
বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী আসিফ জানান, ক্যাম্পাসে আসার পর বৃষ্টি কেন্দ্রীক সময়গুলো খুব মিস করছিলাম। গতকাল রাত থেকেই যখন বৃষ্টি শুরু হয় তখন আমার ভেতরে একটা আনন্দের অনুভূতি কাজ করে। রাতেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে আজকের দিন টা যেকোন ভাবেই হোক উপভোগ করবো। সকালে বৃষ্টি শুরুর পর হলের সবাই ফুটবল খেলতে নেমে যাই। ক্যাম্পাসে এসে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে পারার আনন্দটা শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার কাছে এটা কিঞ্চিত সৌভাগ্যেরও। এরপরে খিচুড়ি-মাংস রান্না করে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করবো। এরচেয়ে সুন্দর ব্যাপার আর কি হতে পারে!
২০২৪ সালে বিশ্বের আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল “Protecting the rights of indigenous peoples in voluntary isolation and initial contact”-বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাথমিক যোগাযোগে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করা।’
বিশ্বজুড়েই অনেক আদিবাসী-জনগোষ্ঠী মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা বেছে নিয়েছেন এবং তাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য তাদের এই বিচ্ছিন্নতায় বেঁচে থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্যও তা বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। প্রাথমিক যোগাযোগে থাকা আদিবাসীরা বনের সেরা রক্ষক। যেখানে ভূমি এবং অঞ্চলগুলির উপর আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে, সেখানে বনগুলোও আদিবাসী সমাজের পাশাপাশি সমৃদ্ধ হয়।
এ বছরের আদিবাসী দিবসে গুরুত্ব পায়, আদিবাসীদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চিন্তা করতে হবে তারা কখন কীভাবে তাদের অধিকার সমুন্নত রেখে বাইরের উন্নয়নকর্মের সাথে যুক্ত হতে চান। মনে রাখা উচিত, কোন ধরণের জোরপূর্বক যোগাযোগ তাদের সাথে করা যাবে না। তাদের সম্মতি ছাড়া অথবা বিনামূল্যে বা জোরপূর্বক পাহাড়ের জমি দখল ও সম্পদ বা খনিজ উত্তোলন, লগিং এবং তাদেরকে অন্যান্য যে কোন ধরনের শোষণ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে তা রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করতে পারে এমন প্যাথোজেনগুলোর বিস্তার রোধে কঠোর রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যে কোন প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের পূর্ণ সম্মতি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুবিধা-বণ্টনসমূহ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থাপন করতে হবে। স্বেচ্ছায় দূরে থাকা বা অতি দূর্গম এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সাথে মিথষ্ক্রিয়ার জন্য সেইসব বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীদের বেছে নিতে হবে যারা আগে থেকেই তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং এই সম্প্রদায়ের ভাষা ও রীতিনীতি বোঝেন। এভাবে তাদের পছন্দকে সম্মান করে ধীরে ধীরে এবং নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সম্প্রদায়গুলোকে তাদের জমি এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষায় সক্রিয় অংশীদার হতে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সংবিধানে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞান বিনিময়ের উদ্দেশ্যে সম্প্রদায়গুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, শাসন কাঠামো এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সেদেশের সরকার সহায়তা প্রদান করতে পারে।
বিচ্ছিন্ন থাকা সম্প্রদায়গুলো এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য বিনিময় এবং সেগুলোর সর্বোত্তম অনুশীলনের সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করাও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়াও সম্প্রদায়গুলোর অধিকার লঙ্ঘন নির্দিষ্ট করার জন্য স্পষ্ট আইনি এবং নীতি কাঠামো স্থাপন করতে হবে। জবাবদিহিতা, প্রতিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য সম্প্রদায়গুলোর জন্য প্রবেশযোগ্য এবং সাংস্কৃতিকভাবে-উপযুক্ত উপায় প্রদান করতে হবে। এই অনুশীলনগুলো মেনে চলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী, সহযোগিতামূলক এবং অধিকার-ভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অতি দূর্গম এলাকায় অথবা সমতলের বিচ্ছিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো যারা সেই বিশেষ অঞ্চলের দীর্ঘযুগের বাসিন্দা তাদের সাথে যোগাযোগের প্রক্রিয়াসমূহ কী এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াতেইবা তাদেরকে কীভাবে সংযোজন করা সম্ভব? এই পরিপ্রেক্ষিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের এক গ্রামের গল্প বলা যাক।
বাংলাদেশের সমতলে বাস করা অনেক মানুষের কাছে এ হয়ত নিছক কল্পনাই বলা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে এমন কিছু জনপদ রয়েছে, যাদের জীবন মোটেই ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো অপার্থিব নয়। রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের অতিদূর্গম অঞ্চলের গ্রাম ‘পুকুর পাড়া’-কে নিয়ে এমন মন্তব্য মোটেই অমূলক হবে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকা থেকে রাঙামাটির দূরত্ব ৩০৬ কিলোমিটার। জেলা সদর থেকে বিলাইছড়ি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু বিলাইছড়ি থেকে রাইক্ষ্যং নদ হয়ে হাঁটা পথে পুকুর পাড়া গ্রামে যেতে অন্ততঃ ৭ দিনের দূরত্ব।
বিলাইছড়ি উপজেলার চারটি ইউনিয়নের একটি হলো বড়থলি ইউনিয়ন, যার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এই ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হলো-শিলছড়ি, রাইমনছড়া, ছালিয়াছড়া, বিলপাড়া, বুরিক্কিয়াছড়া, সাইজাম পাড়া, টাইগার পাড়া , কাইংগছড়া, সাদারীছড়া, সালছড়া, বড়থলি মারমা পাড়া, বড়থলি ত্রিপুরা পাড়া, পুকুর পাড়া, প্রংজাং পাড়া, সুড়হা পাড়া, চারজিং পাড়া, শেপ্রু পাড়া ধুপানিছড়া, হাতিছড়া, এসম ম্রা পাড়া, কেসপাড়া, জারুলছড়ি পাড়া প্রভৃতি। পুকুরপাড়া এলাকাটির ভূ-প্রকৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বিচিত্রতায় পূর্ণ।
প্রশাসনিকভাবে পুকুরপাড়া বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের অন্তর্গত হলেও, অবস্থানগত কারণে পুকুরপাড়ার জনগোষ্ঠী বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার উপর নির্ভরশীল। ২০১৫ সালের আগে এই ইউনিয়নটি বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক সুবিধার্থে নতুন ইউনিয়ন বড়থলির সৃষ্টি হয়। বড়থলি ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচহাজার জন মানুষের বসবাস। এই ইউনিয়নের ‘ধুপানিছড়া পাড়া’ নামক স্থানেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিদেশীয় সীমানা খুঁটির (বাংলাদেশ ভারত এবং মায়ানমারের) অবস্থান।
গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় অঞ্চল হওয়া স্বত্ত্বেও এই অঞ্চলটিই দেশের সবচেয়ে দূর্গম এবং অবহেলিত। তাছাড়া পর্যটনের জন্য এটা অপার সম্ভাবনার স্থান। ৩,৩১৪ ফুট উচ্চতার দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড় ডুমলংও এখানে অবস্থিত। ডুমলং রেং তলাং পর্বতশ্রেণির একটি পাহাড় এবং রাইক্ষ্যং হ্রদের পার্শ্ববর্তী প্রংজাং পাড়ার কাছে এর অবস্থান। একে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে দাবি করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং গভীর প্রাকৃতিক হ্রদ রাইক্ষ্যং (সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১১৭০ ফুঁট উঁচুতে) এই ইউনিয়নের পুকুর পাড়া এবং প্রংজাং পাড়ার ভেতর অবস্থিত।
রাইক্ষ্যং হ্রদের পাড়ে পুকুরপাড়ায় বহু বছর ধরে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই হ্রদের পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ বলে সূর্যের আলো, মেঘ, পাহাড়ের রং, আকাশের রঙেই এর রূপ পরিবর্তিত হয়। এই লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে বিমোহিত করে। লেকের চারপাশে রেং তলাং রেঞ্জের পাহাড়গুলো। এছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত জলপ্রপাত রাইংক্ষ্যং এবং চ্যাদলাং। (চলবে...)