৬০ বছর জীবনের ৩০ বছরই কেটে গেল সেতুর নিচে ঘুমিয়ে!
এখন ৬০ বছর বয়স দক্ষিণ-পশ্চিম নাইজেরিয়ার শহর লাগোসে আসা লিয়া সাদুর। তিনি ৩০ বছর থেকে লাগোসের ওবালেডে সেতুর নিচে বসবাস করছেন।
এখানে আরো ৬০ জন ছিন্নমূল মানুষ বাস করেন তার মতোই। লিয়া সাদু-ই তাদের এখানকার একমাত্র অভিভাবক। যারা কয়েকদিন আগে কিংবা কয়েক বছর আগে এসেছেন, তাদের সবাই লিয়া সাদু-র পরামর্শ মতো চলেন।
লিয়া সাদু একসময় উত্তর নাইজেরিয়ার জামফারায় বসবাস করতেন। সেখানে এখনো তার পরিবার-পরিজন থাকে। ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কারণে জীবিকার তাগিদে ১৯৯৪ সালে লাগোসে চলে আসেন লিয়া সাদু।
লাগোস আগে নাইজেরিয়ার রাজধানী ছিল। ১০৯১ সালে সেখান থেকে রাজধানী সরিয়ে আবুজাতে আনা হয়। লাগোস নাইজেরিয়ার বৃহত্তম একটি শহর।
এ শহরকে ‘ইকোনমিক হাব’ (অর্থনৈতিক এলাকা) বলা হয়। এছাড়া এ শহর শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, রাজনীতি, পর্যটনের জন্য বিখ্যাত।
এ শহরে ২১ লাখ মানুষ বাস করেন। নাইজেরিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী বৃহত্তম শহর হওয়ায় এ শহরের দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। সে কারণে প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবনের চাকা ঘোরাতে লাগোসে এসে হাজির হচ্ছেন অনেকেই।
এর মধ্যে ছিন্নমূল মানুষেরা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ছুটে আসেন। অনেকেরই রাত কাটে রাস্তায়। অনেকে এসে হাজির হন ওবালেডে সেতুর নিচে আশ্রয় পেতে।
এ বিষয়ে লিয়া সাদু বলেন, অনেকের মাধ্যমে এখানে অনেকেই আসেন কিছু করে খাওয়ার আসায়। কেউ এসেছেন ১০ বছর আগে, কেউ এসেছেন কয়েক মাস আগে। সবাই মিলে ৬০ জনের বেশি হবে, যারা সবাই মিলে একটি পরিবারের মতো বাস করি।
তিনি বলেন, যে সব তরুণেরা এখানে আসেন, তাদের আমি ভালো পরামর্শ দিই। এখানে ভালো কিছু করার যেমন সুযোগ আছে, তেমনি মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে অনেক।
লিয়া সাদু বলেন, অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের কারণে এখানে এসেছেন। কেউ এসেছেন চাঁদাবাজির ভয়ে। ৫ বছর আগে এই সেতুর নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৩১ বছর বয়েসি টুকুর গারবা। তিনি নাইজেরিয়ার উত্তরের প্রদেশ কাটসিনা থেকে ১ হাজার কিলোমিটার (৬২১ মাইল) দূর থেকে এসে লিয়া সাদুর কাছে আশ্রয় পান।
লিয়া সাদু সম্পর্কে টুকুর গারবা বলেন, তিনি (লিয়া সাদু) অনেক আগে এখানে এসেছেন। তিনি আমাদের বড়ভাইয়ের মতো। আমরা তার কাছে থেকে অনেক ভালো পরামর্শ পাই। কারণ, তিনি অনেক আগে থেকেই এই লাগোস শহরে আছেন। সে জন্য আমরা সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা পাই।
এই সেতুর কাছেই এক অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন আদামু সাহারা। ৩০ বছর ধরে এখানেই বাস করছেন।
আদামু সাহারা বলেন, লাগোসে ক্রমাগত ছিন্নমূল মানুষদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষত, নিরাপত্তাহীনতা এবং জিহাদিদের তৎপরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে কারণে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে অনেকেই পালিয়ে এসে লাগোসে আশ্রয় নিচ্ছেন।
নাইজেরিয়ার নেতৃবৃন্দকে অনুধাবন করতে হবে দেশে কী ঘটে চলেছে। তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। সমস্যার কারণেই অনেক ছিন্নমূল মানুষ এই লাগোসের সেতুর নিচে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সেতুর নিচে বসবাসকারী কেউই আর তাদের এলাকা জামফারায় ফিরে যেতে চান না। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, এখানে আয়ের সুযোগ আছে। জামফারায় গুম হওয়ার ভয় আছে। তারপরে সেখানে ডাকাতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
তবে তাদের আতঙ্কের মধ্যেও সময় কাটাতে হয় উচ্ছেদের ভয়ে। পরিবেশ কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে রাত দুইটার সময় এসে হাজির হয়। কিন্তু তাদের ভাবতে আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
সেতুর নিচের ছিন্নমূল মানুষেরা কাছাকাছি একটি শৌচালয়ে যান শৌচ কাজ এবং গোসল করতে। এ জন্য তাদের ১শ নাইরা (০.০৬ ডলার/ ০.০৫ পাউন্ড) ব্যয় করতে হয়।
লিয়া সাদু সেতুর নিচে এতদিন থাকার পরে ঘুমানোর জন্য একটি ম্যাটেস কেনার মতো সামর্থ্য অর্জন করেছেন। এছাড়া একটি কাঠের আলমিরা এবং মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য মশারিও কিনেছেন একটা।
এর আগে লিয়া সাদু জুতা পালিশ করার কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন জিনিসের ভাঙরি বিক্রি করে জীবনধারণ করেন। তার রোজকার আয় ৫ হাজার নাইরা (৩ ডলার/২ পাউন্ড)। বিবিসি অবলম্বনে লেখা।