ভয়াবহ বন্যায় ডুবছে বিভিন্ন জেলা, পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কায় এলাকাবাসী
দেশে শনির দশা চলছে। বর্তমানে নানাদিক থেকে বেশ সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। এরই মধ্যে জনসাধারণের কপালে চিন্তার নতুন ভাঁজ ফেলেছে ভয়াবহ বন্যা। হঠাৎ করে দেশের বেশ কিছু নদীর পানি বেড়ে গিয়ে পাশ্ববর্তী জেলাগুলো প্লাবিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যার ভুক্তভোগী ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি এসব জেলার মানুষ। তাদের সামনে যেন আচমকা স্রোতস্বিনী জলদানব এসে প্রকট হয়েছে।
দীর্ঘদিন এমন ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা হয়নি সাধারণ মানুষের। সেই কারণে বিপজ্জ্নক অঞ্চলে অবস্থিত মানুষের মধ্যে ভয় বিরাজ করছে। তাদের পারিবারিক বিভিন্ন জিনিসের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন প্রাণ বাঁচাতে আকুল আকুতি আর কান্নার রোল শোনা যায় কেবল!
চলমান এই বন্যা পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যেই জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নিম্ন অঞ্চল তো ডুবেছেই, এসব জেলার মধ্যম আর উচু স্থানেও কোমড় পানি ছাড়িয়ে গলাপানি হওয়ার উপক্রম। কলাগাছের ভেলা, নৌকা, ট্রলার যে যেভাবে পারছে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তবে প্লাবিত অঞ্চলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মাছের ঘের, হাঁস-মুরগীর খামার ডুবে ব্যবসা বাণিজ্যের তো ক্ষতি হচ্ছেই; তাছাড়া ডুবে গেছে নিম্ন অঞ্চলের সব বাড়িঘর।
ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুহুরী-সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফেনীর পরশুরাম-ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
ফেনীতে বসবাসকারী বন্যা কবলিত এক খামার মালিক বলেন, ‘আমার বয়সে আমি আর এমন বন্যা দেখি নাই। এমন কোমড় তামাইত পানি! আমার গরু আছে, বাছুর-টাছুরসহ প্রায় ১৬ ডা। এগুনো রাইগো জায়গা নাই কুনোখানে। আর আমরাও থাকার কুনো জায়গা নাই।
আরেক চা বিক্রেতা মজিদ মিঞা বলেন, ‘এর আগে বন্যা হইছে, এরথেকে কম হইছে। কিন্তু এতবড় বন্যা এর আগে কখনো হয় নাই। সব চলি গ্যাছে বাড়ি-ঘর ছাড়ি দি। ধান-চাউল সব কিছু নষ্ট হই গ্যাছে।’
এক গৃহকর্তা বলেন, ‘উঠানে আমার বুক সমান পানি। আমার ঘরের ভিতরে ধরেন আমার হাঁডু সমান। কোনোরকমে গ্যাসের চুলা আর ফ্রিজডা সেইভ করছি। আরগুলা সব ওইভাবেই রইছে।’
কুমিল্লার গোমতি নদীর পানিও মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) বিকালের পর বিপৎসীমা অতিক্রম করতে শুরু করে। স্থানীয় এক নারী বলেন,‘ আমরা তো জানি না এতক্ষুণ যে পানি উডবো। পরে মাল ছামানা কিচ্ছুই বাইর করতে পারছি না, সব পানির তলে। এহন আমরা কই থাকমু, কি করমু জায়গা পাইতাছি না। একটা জ্বালার ভিতরে আছি।’
কুমিল্লা চর অঞ্চলের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘গত ৪-৫ দিনের টানা বৃষ্টির কারণে পানি আরও বাড়ছে। আবার ইন্ডিয়া থিকা নাকি ডুমুরিয়ার যে বাঁধ আছে সেইখানে সমস্যা হওয়ার কারণে সব পানি ছাইড়া দিছে। এই কারণে এইদিকে আরও সমস্যা হইছে। এলাকার মানুষ আসবাবপত্র সরাইতে সাহায্য করতাছে।’
নোয়াখালী অঞ্চলেও ফেনীর মহুরী নদীর পানি ঢুকতে শুরু করেছে। স্থানীয়রা বলছে, ‘জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করায় মানুষজন ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।’
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে বিভিন্ন অবৈধ বাঁধ কেটে পানি স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য উপজেলা পর্যায়ের সকল মাধ্যমিক, প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
বন্যার্ত কিছু অঞ্চলের মানুষ যোগাযোগ করতেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রাণ বাঁচাতে ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্বল ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে মানুষ। আরও আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, সামনে ঝড় হয়ে এই বন্যার পানি আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা হলে দেশের বড় ক্ষতি তো হবেই, তার সাথে মানুষের প্রাণহানীও হতে পারে।
টানা কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এরকম ভয়ংকর বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২৪ ঘণ্টা কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার গোমতি, মুহুরী ও হালদা নদীর পানি সতল বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। ফেনী ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে ও কুমিল্লার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে ফেনীর মুহুরী-সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
যদিও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। আটকে পড়া এবং বিপদগ্রস্থ মানুষদের উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত রয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তবে তা সত্ত্বেও ক্ষয়ক্ষতি কতটা আটকানো যাবে, তা বেশ চিন্তার বিষয়।