বিশ্বদরবারে একজন প্রচারবিমুখ বাঙালি বিজ্ঞানী

  • নিশীথ দাস, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম

বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম

২০০১ সালের মাঝামাঝিতে পৃথিবী ধ্বংসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। এই আতঙ্ক প্রশমিত করেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি বিজ্ঞানী। তিনি গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহ প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী একই সরলরেখায় এলেও এর প্রভাবে পৃথিবীতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই। যিনি এমন আশার বাণী শুনিয়েছিলেন, তার নাম জামাল নজরুল ইসলাম। সংক্ষেপে তিনি জে এন ইসলাম নামেই পরিচিত। অনন্য এই বিজ্ঞানী বাঙালির গর্ব।

বিশ্বের দরবারে নিজের গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশাল এক উচ্চতায়। বাঙালির কাছে এটা আনন্দের সংবাদ হলেও নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে দেশে অনেকেই হয়তো এখনো অজ্ঞ। পশ্চিমা বিশ্বে তার গবেষণা নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়েছে, দেশে তার বিন্দুমাত্র হয়নি। স্টিফেন হকিং-এর A Brief History of Time ১৯৮৮ সালে প্রকাশের আগেই তিনি মহাবিশ্বের পরিণতি কী হতে পারে বা কী হবে এমন জটিল বিষয় সম্পর্কে The Ultimat Fate of the Universe নামক বইটি লেখেন। এটি কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশ পেলে বিজ্ঞানী মহলে বেশ সাড়া পড়ে। জাপানি, ফ্রেঞ্চ, ইতালীয়, পর্তুগিজ ও যুগোস্লাভ ভাষায় অনূদিত হয় বইটি। তাছাড়া তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতা ও চার্জিত বস্তুর ওপর গবেষণা করে লেখেন Rotating fields in general relativity বইটি। যা কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। তার রচিত মহাবিশ্ব কেন্দ্রিক একাধিক গ্রন্থ কেম্ব্রিজ, প্রিন্সটন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ ছিলেন। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাতি সম্পন্ন।

বিজ্ঞাপন

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563970056510.jpg

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামে। তার শৈশব কেটেছে কলকাতায়। স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ কম ছিল। ঘোরাঘুরির প্রতি ভালো লাগা ছিল প্রচণ্ড। কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এসে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। কর্তৃপক্ষ তার কৃতিত্ব দেখে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে সরাসরি ভর্তি করে নেয়। এখানে পড়ার সময় তার গণিতের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়। জ্যামিতির চর্চাও প্রচুর হয়। নবম শ্রেণিতে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানে লরেন্স কলেজে পড়তে যান। সেখানে সিনিয়র কেম্ব্রিজ ও হায়ার কেম্ব্রিজ পাস করেন। এরপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স করে পড়তে যান কেম্ব্রিজে। কেম্ব্রিজে আবার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এমএ করেন সেখান থেকেই। প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন। এছাড়া পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রিও অর্জন করেন—উল্লেখ্য, দুলর্ভ এই ডিগ্রি বিশ্বের খুব কম বিজ্ঞানী লাভ করতে পেরেছেন।

তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফাদার গোরের কাছ থেকে গণিতের অনেক কিছু শিখেছিলেন। গণিতের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল বলেই তার সাথে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকবার এই শিক্ষকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। এর পিছনেও ছিল গণিত নিয়ে প্রশ্ন কিংবা জানার আগ্রহ।

ইংল্যান্ডে পড়াকালীন তার প্রতি স্নেহের টানে জন টেইলর নামে এক শিক্ষক জামাল নজরুল ইসলামের পাশেই বাসা নিয়েছিলেন। গণিতের নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা বিনিময় হয়েছিল দুজনের মধ্যে। টেইলর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বাংলাদেশ সফরে একবার এসেওছিলেন।

জামাল নজরুল ইসলামের কাছের বন্ধুদের তালিকায় অমর্ত্য সেন, জোসেফসন, আবদুস সালাম, স্টিফেন হকিং প্রমুখ ছিলেন। আবদুস সালাম ও অমর্ত্য সেন বয়সে তার জ্যেষ্ঠ আর হকিং কনিষ্ঠ। ১৯৫৭ সালে তিনি যখন কেম্ব্রিজে পড়তে যান সেসময় অমর্ত্য সেন ট্রিনিটি কলেজের ফেলো। ১৯৫৯ সালে ভারতের অর্থনীতিবিদ অমিয় বাগচীর মাধ্যমে অমর্ত্য সেনের সাথে পরিচয় ঘটে। এখান থেকে সম্পর্কের শুরু হয়ে গভীর বন্ধুতায় গড়িয়েছিল। ১৯৯০ সালে অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে এলে চট্টগ্রামে তার বাসাতেই ছিলেন। আবার বিলেতে গেলে জামাল নজরুল ইসলামও অমর্ত্য সেনের বাসায় যেতে ভুলতেন না। গাণিতিক অর্থনীতির ওপর অমর্ত্য সেন আর বিশুদ্ধ গণিতের ওপর জামাল নজরুলের আগ্রহ ছিল। তাদের পছন্দের জায়গা ছিল গণিতই। তাই সম্পর্ক গভীর হওয়াই স্বাভাবিক।

জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৬৩-৬৫ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭-৭১ পর্যন্ত কেম্ব্রিজ ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে গবেষণা করেছেন। আবার ১৯৭১-৭২ পর্যন্ত ক্যালটেক বা ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭৩-৭৪ পর্যন্ত লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সালের কিছু সময় পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ সালের বাকি সময় থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৮১ সালে এক বছরের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৮১ সালে প্রথমবার যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এ সময় তার বেতন ছিল আটাশশো টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কিছুতেই রাজি হয়নি তাকে তিন হাজার টাকা বেতন দিতে। এক বছর অধ্যাপনা করার পর গবেষণার জন্য লন্ডন যাবার প্রয়োজন দেখা দিলে কর্তৃপক্ষ ছুটি দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান। কাজ সম্পন্ন করে একেবারে দেশে চলে এলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেতন তিন হাজার টাকায় উন্নীত করে মাঝখানের সময়টিকে শিক্ষা ছুটি হিসেবে গ্রহণ করে। তিনি এখানেই প্রতিষ্ঠা করেছেন Research Centre for Mathematical and Physical Sciences প্রতিষ্ঠানটি। এটি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম ১৯৮৯ সালে উদ্বোধন করতে আসেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/24/1563970202539.jpg

প্রবাসে থেকেই ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের ওপর পাক হানাদারদের আক্রমণ বন্ধের জন্য চিঠি লেখেন। দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি উচ্চাভিলাষী জীবন পরিত্যাগ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। এমনকি দেশপ্রেমিক এই মানুষটি মুহাম্মদ জাফর ইকবালকেও দেশে ফেরার তাগিদ দিয়েছিলেন।

তিনি অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন ছিলেন বলে কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতেন না। তিনি ভাবতেন মাথা খাটিয়ে করলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। তাই এসব যন্ত্রের প্রতি আগ্রহ কম থাকলেও এসবের গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি।

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ২০০০ সালে কাজী মাহবুবুল্লাহ ও জেবুন্নেছা পদক পান। ২০০১ সালে লাভ করেন একুশে পদক। এছাড়াও ২০১১ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক পান।

উল্লেখ্য, তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিয়াড কমিটি, রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেম্ব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সদস্য ছিলেন।

ইংরেজিতে লেখা তার অন্য দুটো বই হচ্ছে— An Introduction to Mathematical Cosmology, The Far Future of the Universe. এছাড়া বাংলা একাডেমি থেকে বাংলায় প্রকাশিত ‘কৃষ্ণ বিবর’ (ব্ল্যাক হোল) বাদেও অন্য প্রকাশনী থেকে তার আরো দুটি বাংলায় লেখা বই—‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘শিল্পসাহিত্য ও সমাজ’ প্রকাশিত হয়।

তিনি ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।