প্রথম বাঙালি নারীবাদী বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের জমিদার ছিলেন। বয়স যখন পাঁচ, তখন কলকাতায় এক মেমের কাছে পড়াশোনা শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। বেশিদিন তা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি, পারিবারিক ও সামাজিক বাধায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। রোকেয়ার বড় দুই ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করে তারা ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসেন। তাদের চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে। রোকেয়ার বড়বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দুই ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল।
বড় ভাইবোনদের সহায়তায় তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং আরবি ভাষা শিখেছিলেন।
বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে। স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের বয়স তখন ৩৮। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। সাখাওয়াত হোসেন তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর রোকেয়াকে বিয়ে করেন। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিকদের লেখার সাথে পরিচিত হন। এইসময় তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং তার নিজের সাহিত্য রচনাও শুরু করেন।
১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি গল্প লিখেন বেগম রোকেয়া। এর মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯০৯ সালে স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। তাদের দুই কন্যাসন্তানও জন্মগ্রহণ করে অকালে মারা যায়।
স্বামীর মৃত্যুর পর তার প্রদত্ত অর্থ দিয়ে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ছাত্রীসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। ভাগলপুরে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। পরে পারিবারিক কারণে কলকাতায় স্থানান্তর করেছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে পর্দাবেষ্টিত বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে ছাত্রীদের আনা-নেওয়া করা হতো। বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি সেলাই, রান্না, শরীরচর্চা এবং সংগীত শেখানো হতো সেখানে। ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম। ১৯৩০ সালে তিনি মেয়েদের জন্য একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন। সরোজিনী নাইডু তার এই কাজের প্রশংসা করেছিলেন।
বেগম রোকেয়া বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী তাঁর সৃজনশীল লেখনী। ‘মতিচুর’ প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে প্রথম তাঁর নারীবাদী অবস্থান প্রকাশিত হয়। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্যের ক্লাসিক নিদর্শন বলে বিবেচিত।
যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বেগম রোকেয়া সম্পর্কে তাঁর ‘বঙ্গের মহিলা কবি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বঙ্গের মহিলা কবিদের মধ্যে মিসেস আর, এস, হোসেনের নাম স্মরণীয়। বাঙ্গালাদেশের মুসলমান-নারী প্রগতির ইতিহাস-লেখক এই নামটিকে কখনো ভুলিতে পারিবেন না। রোকেয়ার জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। গভীর রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে চুপি চুপি বিছানা ছাড়িয়া বালিকা মোমবাতির আলোকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে ইংরাজি ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ করিতেন। পদে পদে গঞ্জনা সহিয়াও এভাবে দিনের পর দিন তাঁহার শিক্ষার দ্রুত উন্নতি হইতে লাগিল। কতখানি আগ্রহ ও একাগ্রতা থাকিলে মানুষ শিক্ষার জন্য এরূপ কঠোর সাধনা করিতে পারে তাহা ভাবিবার বিষয়।”
প্রথম বাঙালি নারীবাদী বেগম রোকেয়া ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন। রংপুর বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যা বাংলাদেশে প্রথম কোনো নারীর নামে বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হল নামে আবাসিক হল রয়েছে। বেগম রোকেয়ার ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাঁর স্মরণে একটি ডুডল তৈরি করে৷ গুগলের হোম পেইজে গেলেই দেখা গেছে এক জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের দৃশ্যপট। সাদা পোশাকের চশমা পরা এক নারী বই হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় ইনিই হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
১৯৩২ সালের জন্মদিনে ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বাংলাদেশে ৯ ডিসেম্বরে বেগম রোকেয়া দিবস পালিত হয়।