মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নত্ববাদ এবং পররাষ্ট্রনীতি

  • মূল : জোসেফ এস. নাই জুনিয়র , ভাষান্তর: তোফায়েল আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জোসেফ এস. নাই জুনিয়র/ ছবি: সংগৃহীত

জোসেফ এস. নাই জুনিয়র/ ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি আমেরিকার ১৪ জন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আমার একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে যারা ১৯৪৫ সাল থেকে দেশ পরিচালনা করেছেন যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘নৈতিকতা প্রয়োজনীয় কি না’। গবেষণার ফলাফল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নৈতিক পররাষ্ট্রনীতি চায়, কিন্তু সেই প্রচেষ্টাতে বারবার ফাটল ধরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ প্রায়ই তাদের দেশকে অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্ন ভাবেন, কারণ আমরা আমাদের দেশকে জাতিগত এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দ্বারা সংজ্ঞায়ন করি না, একইসাথে এই রাষ্ট্রের একটি উদারনৈতিক ভিশন রয়েছে যার জীবনধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ভিত্তির ওপর স্থাপিত।’

অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নত্ব শুরু থেকেই স্ববিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের উদারবাদী বার্তা সত্ত্বেও দাস প্রথার আসল পাপ সংবিধানে লেখা হয়ে গিয়েছিল যখন উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত রাষ্ট্রগুলো সমঝোতায় আসে। পররাষ্ট্রনীতিতে কীভাবে উদারবাদ প্রকাশে করা হবে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে সবমসময়ই মতদ্বৈধতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিন্নত্ব মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের উপেক্ষা, অন্যদেশে আগ্রাসন চালানো এবং জনগণের ওপর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধ সরকারকে চাপিয়ে দেয়ার অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নত্ব বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক আইন এবং সংগঠন, যেগুলো বহির্মুখী হুমকিকে কমিয়ে অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা রক্ষা করে এরকম উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা ছড়িয়ে দেয়ার অনুপ্রেরণা যাতে বিশ্বকে আরও মুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ করা যায়।

বিজ্ঞাপন

অবশ্যই ট্রাম্প উভয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ট্রাম্প তার অভিষেক ভাষণে ঘোষণা করেন— ‘সবার আগে আমেরিকা…আমরা বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব এবং হৃদ্যতা চাই, কিন্তু আমরা সবাইকে এটা জানাচ্ছি যে প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই সবার আগে তার জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কারও ওপর আমাদের জীবনধারা চাপিয়ে দিতে চাই না বরং এটাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যাতে এটাকে তারা উদাহরণ হিসেবে নেয়। এটা অবশ্য তার ভালো বক্তব্য ছিল। যখন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভালো উদাহরণ তৈরি করে, তখন তা অন্যদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।’

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ এবং যুদ্ধংদেহী ঐতিহ্যও রয়েছে। উড্রো উইলসন এমন এক পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা বিশ্বকে গণতন্ত্রের জন্যে নিরাপদ করে তুলবে। জন এফ কেনেডি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বৈচিত্র্যের জন্য নিরাপদ করে তোলার কথা বলেছিলেন, আবার তিনিই ভিয়েতনামে ১৬০০০ মার্কিন সৈন্য পাঠান যা তার উত্তরসূরি লিন্ডন বি. জনসনের সময় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৫৬৫০০০ জনে। একইরকম ভাবে জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের পক্ষে জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির মাধমেই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যেখানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতপক্ষে শীতল যুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাতটা যুদ্ধ এবং সামরিক হস্তক্ষেপে জড়িয়েছে। কিন্তু রোনান্ড রিগ্যান যা বলেছিলেন— ‘বেয়নেটের দ্বারা যে শ্বাসন প্রতিষ্ঠা করা হয় তার মূলে শক্ত ভিত্তি থাকে না।’ এসব সংকট এড়িয়ে চলা ট্রাম্পের অন্যতম জনপ্রিয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন এবং নির্বাচনের আগে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ইচ্ছার কথাও ব্যক্ত করেছেন।
দুটি মহাসাগর ও দুর্বল প্রতিবেশি বেষ্টিত যুক্তরাষ্ট্র উনবিংশ শতাব্দীতে বড়মাপে পশ্চিমমুখী বিস্তারে মনোযোগী ছিল এবং ইউরোপে বিশ্বশক্তিদের সাথে শক্তির ভারসাম্যে (balance of power) জড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, যাইহোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়ানোর মাধ্যমে শক্তির ভারসাম্যে জড়িয়ে যায়। ১৯৩০ এর দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ মনে করছিল ইউরোপে তাদের হস্তক্ষেপ ভুল ছিল যার ফলাফলে যুক্তরাষ্ট্র আবার বিচ্ছিন্নতার (কোনো কিছুতে নিজেকে না জড়ানোর নীতি) দিকে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, তার উত্তরসূরী হেরী এস. ট্রুমান এবং অন্যরা অনুধাবন করেন যুক্তরাষ্ট্রকে আবার বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

তারা বুঝতে পেরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের বিচ্ছিন্নতাবাদের দ্বিতীয় উৎস। পৃথিবীর একক বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তি যদি ‘বৈশ্বিক সাধারণ পণ্য’ (global public goods) নেতৃত্ব না দেয় তবে তা আর কেউই সক্ষম হবে না। যুদ্ধোত্তর প্রেসিডেন্টরা অনেকগুলো নিরাপত্তা জোট, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানাদি এবং অপেক্ষাকৃত মুক্ত অর্থনৈতিক পলিসি তৈরি করেছিলেন। আজ এই ‘উদারবাদি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা’ যা সত্তর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে, তা চীন এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্য জনতুষ্টিবাদীদের ক্রমাগত উত্থানের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে।

২০১৬ সালে ট্রাম্প সফলভাবে এই ধারার (জনতুষ্টিবাদের) সূচনা করেন যখন তিনি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসবে মনোনীত হন। ট্রাম্পের সূচিত ধারা ১৯৪৫ সাল থেকে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক যে ধারা চলে আসছে তার বিচ্যুতি ঘঠায়। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র ও প্রতিষ্ঠানাদির প্রতি তিনি যে ঘৃণা উৎপাদন করেছেন সেটাই তার নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছে। শিকাগো গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের এক জনমত জরিপে দেখা গেছে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আমেরিকান বহির্মুখী পররাষ্ট্রনীতি চান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় নীতি হচ্ছে সামরিক হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলে বহুপাক্ষিক সহযোগীতা ও জোটের সাথে সম্পর্ক জোরদার রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ১৯৩০ এর দশকের মতো নিজেদের বিচ্ছিন্নতাবাদদের দিকে নিয়ে যেতে চায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে তা হল যু্ক্তরাষ্টীয় ভিন্নত্ববাদের জনপ্রিয় দুটি স্তম্ভ— বেয়নেট ছাড়া গণতন্ত্রের প্রসার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা করা তা ধরে রাখতে পারবে কি না। আমরা কি সামরিক হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধবাদ ছাড়াই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘঠানো শিখতে পারি? এবং একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, সাইবার ক্রাইম, সন্ত্রাসবাদ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা মুক্তির জন্য যে নব্য ব্যবস্থা, আইন কানুন ও প্রতিষ্ঠান দরকার তা গড়ে তুলতে পারি?

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র উভয়ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেখানে নেতৃত্ব দেয়া দরকার, সেখানে করে ট্রাম্প প্রশাসন মহামারির জন্য চীনকে দোষারোপ করছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের হুমকি দিচ্ছেন।

চীনকে জবাবদিহি করানোর অনেক কিছুই রয়েছে। কিন্ত আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় যে চীন ইস্যুকে খেলার মাঠে পরিণত করা হয়েছে তা আসলে পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়, তা ঘরোয়া নীতি। আমরা এখনোও মহামারী থেকে সেরে উঠি নাই এবং এই কোভিড-১৯ ই শেষ কথা নয়।

অধিকন্তু, চীন এবং মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে যা মানবজাতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। কোনো দেশই এসব জাতীয় নিরাপত্তা সমস্যা একা সমাধান করতে পারবে না। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র ও চীন এমন এক সম্পর্কের মধ্যে আছে যা কাম্য নয় এবং তা অবশ্যই প্রতিযোগিতা একইসাথে সহযোগিতার সমন্বয় দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যু্ক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘ভিন্নত্ব’ বলতে এখন চীনের সাথে মিলে ‘বৈশ্বিক সাধারন পণ্য’ উৎপাদন ও সহযোগিতা বোঝাবে, একইসাথে মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধের পক্ষেও কথা বলবে।

অনুবাদক:তোফায়েল আহমেদ (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মূল লেখক: জোসেফ এস. নাই জুনিয়র, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব গভর্নমেন্টের সাবেক ডিন।