নোয়াহ হারারির কল্পিত বাস্তবতা ও সমকালীন সমাজ
হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেম-এর ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর ইয়োভাল নোয়াহ হারারি আমার অন্যতম প্রিয় ব্যাক্তিত্ব। তিনি তিনটি সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক, যেগুলো হলো, ‘সেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অব ম্যানকাইন্ড’, ‘হোমো ডিউস’ এবং ‘টুয়েন্টি ওয়ান লেসন ফর দি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরী’। আমার এই লেখার আলোচনা এগিয়েছে তার প্রথম বই ‘সেপিয়েন্স’-এর সূত্র ধরে। হারারি তার ‘সেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অব মেনকাইন্ড’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ৭০,০০০ বছর পূর্বে যে হোমো সেপিয়েন্স তথা মানব প্রজাতির প্রভাব পৃথিবীতে একটা জেলিফিশের প্রভাবের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না, সেই প্রজাতি কিভাবে সময় পরিক্রমায় এই ধরণীতে তার একক শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে সক্ষম হলো?
এর কারণ হিসেবে তিনি যা বলেছেন সংক্ষেপে তাহলো, মানব প্রজাতির বিশাল সংখ্যায় নমনীয় হয়ে একে অন্যর সাথে সহযোগী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারার ক্ষমতা যা অন্য কোনো প্রজাতির বেলায় দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পনের থেকে বিশটা শিম্পাঞ্জীর দল দেখতে পাবেন কিন্তু এক হাজার শিম্পাঞ্জীর কোনো দল দেখতে পাবেন না। আপনি চল্লিশ হাজার মানুষকে একসাথে বসে মিরপুর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করতে দেখতে পারেন, কিন্তু চল্লিশ হাজার শিম্পাঞ্জী মিরপুর স্টেডিয়ামে একসাথে ছেড়ে দেওয়া হলে যা দেখতে পাবেন তাহলো চরম বিশৃংঙ্খলা, একেবারে পাগলামীর চূড়ান্ত।
প্রশ্ন হলো মানুষ নিজেদের মধ্যে কিভাবে বিশাল সংখ্যায় এইরকম সহযোগী সম্পর্কের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছে? হারারির মতে, মানুষের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষমতা অর্জনের পেছনে যে কারণ তাহলো—তারা গল্প তৈরি করতে পারে এবং সে গল্প যখন সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে তখন তারা সবাই একই রকমের আচার, মূল্যবোধ ধারণ করে, ফলত: তাদের সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হয়। হারারির কাছে এই গল্পগুলোর উদাহরণ হলো ধর্ম, জাতি, রাষ্ট্র, করপোরেশন, অর্থ ইত্যাদি, এগুলো হলো ফিকশনাল রিয়েলিটি বা কল্পিত বাস্তবতা। অর্থাৎ, মানুষ বসবাস করে দ্বৈত বাস্তবতায়। একটা হলো অবজেক্টিভ রিয়েলিটি, যেমন, পাহাড়, নদী, গাছ, মানুষের নিজের শরীর ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকটা হলো ফিকশনাল রিয়েলিটি যা মানুষ তার কনশাসনেস বা চিন্তা শক্তির মাধ্যমে তৈরি করে। তাহলে আপনি নিরেট বাস্তবতা থেকে কল্পিত বাস্তবতা আলাদা করবেন কিভাবে?
হারারির পদ্ধতি খুবই চমকপ্রদ আবার খুব সরল। তার মতে যা কিছু যন্ত্রণা ভোগ করতে পারে না তাই ফিকশনাল রিয়েলিটি। যেমন, জাতি বা রাষ্ট্র। আমরা প্রায়শই বলি অমুক রাষ্ট্র তমুক রাষ্ট্রের কাছে বা অমুক জাতি তমুক জাতির কাছে পরাজিত হয়েছে কিংবা নতি স্বীকার করেছে। কিন্তু জাতি কি আসলে কোনো যন্ত্রণা ভোগ করছে? রাষ্ট্র কি কোনো যন্ত্রণা ভোগ করছে? উত্তর হলো, না। কারণ এগুলো কোনো নিরেট বাস্তবতা নয়, এগুলো আমাদের কল্পিত বাস্তবতা। কিন্তু যন্ত্রণা বা দুর্দশা ভোগ করে আসলে মানুষ, অমুক কল্পিত জাতির অন্তর্ভুক্ত রক্ত-মাংসের শরীরের মানুষ। সুতরাং নিরেট বাস্তবতা যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো মানুষ, তার শরীর। জাতি বা রাষ্ট্র নয়।
হারারি তার বিভিন্ন লেকচারে বা পাবলিক আলোচনায় এটা অকপটে বলেছেন যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পেছনে এমনসব কল্পিত বাস্তবতা বা গল্পগুলোর ভূমিকা হচ্ছে প্রধান নিয়ামক। আপনি বেবুনদের কোনো দলের কাছে গিযে বেবুন সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বক্তৃতা দিয়ে সুবিধা করতে পারবেন না। কিংবা কোনো বেবুনকে দশ টাকার নোট দিয়ে দুইটা কলা দিতে বললে কোন সাড়া পাবেন না। কারণ দশ টাকার নোট তার কাছে অর্থহীন, তাকে বরং আপনি একটা নারিকেল দিলে সে আপনাকে একটা কলা দিতে পারে। কারণ সে শুধুমাত্রই অবজেক্টিভ রিয়েলিটিতে বাস করে, কিন্তু মানুষ অন্যএকটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে দশটাকা দিয়ে আরামসে দুইটা কলা কিনে নিয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে খেয়ে চলে আসতে পারে, কারণ অর্থ নামক গল্পে সমগ্র মানব জাতি বিশ্বাস করে। হারারির মতে, টাকা হলো মানুষ উদ্ভাবিত পৃথিবীর সবচেয়ে সফল গল্প। সবাই এক ধর্মে, এক খোদায়, এক জাতিতে কিংবা এক রাষ্ট্রে বিশ্বাস না করলেও টাকার গল্পে সবাই বিশ্বাস করে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, লাদেন আমেরিকান জাতি বা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও আমেরিকান ডলার নিতে বা ব্যবহার করতে কোনোদিন আপত্তি করেননি। অর্থাৎ, মানুষের সফল হবার পেছনে তাদের গল্প উদ্ভাবন এবং সেসব গল্পে বিশ্বাস স্থাপন করার ক্ষমতাই প্রধান।
কিন্তু হারারির আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো কিভাবে এই গল্পগুলোই বা ফিকশনাল রিয়েলিটিগুলোই আবার মানব প্রজাতির ইতিহাসের পরিক্রমায় মানুষের কষ্ট, দুর্দশা, যন্ত্রণা এবং ধ্বংসের মূল কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই হলোকাস্টের ঘটনাটাই যদি দেখি তবে দেখব যে, হিটলার বা নাৎসি বাহিনীর বিপুল হত্যাযজ্ঞের পেছনে মূল কারণ ছিল জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের গল্প। কিন্তু প্রকৃতিতে বা অবজেক্টিভ রিয়েলিটিতে এমন কোনো পরিমাপক নেই বা মানদণ্ড নেই যেখানে আপনি মাপতে পারবেন কোনো জাতি থেকে কোনো জাতি শ্রেষ্ঠ অথবা কোনো ধর্ম থেকে কোনো ধর্ম শ্রেষ্ঠ। ভিন্ন ভিন্ন গল্পের ভোক্তারা তাদের গল্পকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং সেই শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণে ব্যাতিব্যস্ত থাকে, প্রয়োজনে খুন করে, গণহত্যা সংঘটিত করে, জাতিগত নিধনে লিপ্ত হয় কিংবা ধর্মযুদ্ধে যায়। সবকিছুই এই গল্পগুলোর জন্য আদতে যেগুলোর কোনো জৈবিক সত্তা নেই, এগুলোর অস্তিত্ব কেবল মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাপ্রণালীর মধ্যেই গ্রথিত।
হারারির সেপিয়েন্স পড়ে এবং তার আলোচনাগুলো শুনে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই যে ফিকশনগুলো সেগুলো আমাদের সমাজকে কিভাবে বেঁধে রেখেছে আবার কিভাবে আমাদের সমাজে অন্যায়, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, অবিচারকে টিকিয়ে রাখছে? সত্যিকার অর্থে আমি যা দেখি তাহলো ফিকশন এবং মিথগুলোর জন্য নিরেট বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষরা একে অন্যর ক্ষতি করতে ব্যস্ত। জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম, সরকার, রাষ্ট্র, অর্থ নামের কল্পিত গল্পগুলো হয়ে উঠেছে মানুষের নিজের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী—এগুলোর দোহাই দিয়ে এক ঝটকায় কাউকে রক্তাক্ত করা, খুন করা, গুম করা, জেলে পুরে দেওয়া যায়। যারা এই গল্পগুলো থেকে বাস্তবতা আলাদা করতে পারেন না (সিংহভাগ মানুষ) তারা এই গল্পগুলো অক্ষত রাখতে ইচ্ছুক, আরো শক্তিশালী করতে ইচ্ছুক, সেজন্য যাই করা লাগুক না কেনো। যারা এই গল্পগুলো চ্যালেঞ্জ করেন তাদের সাথে এই সিংহভাগের তৈরি হয় দুর্দান্ত অপছন্দের সম্পর্ক। আর এভাবেই চলতে থাকে অন্যায্যতা।
হারারি এই সমস্যাগুলোর পেছনে কল্পিত বাস্তবতাগুলোর ভূমিকা দুর্দান্তভাবে ব্যাখ্যা করলেও এ থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে তা নিয়ে তেমন কিছু বলেন না। প্রশ্ন আসে তাহলে মানুষের হাতে সম্ভাব্য বিকল্প কী হতে পারে? তবে কি সময় এসেছে নতুন গল্প তৈরির, এমন কোনো গল্প যে গল্প একক কোনো গল্পের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মাথা ঘামাবে না? যে গল্প নিজেই খোদ বহুবিধ গল্পের সমাহার, যে গল্পের কোনো শেষ নেই বরং নতুন নতুন সংযুক্তি আছে। হয়তো এভাবেই আমাদের সুযোগ আছে বহুধা এবং বহুবিধ গল্পের শেষ না হওয়া একটা সংকলন হিসেবে টিকে থাকার, নতুবা যখন যে গল্প শক্তিশালী হবে সে গল্প গিলে ফেলতে চাইবে অন্য সকল গল্পগুলোকে। তবে হারারি ঠিক এভাবে না বললেও আমার মতে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে জরুরি হলো, মিথ/ কল্পগাথা/ কিংবদন্তী/ গল্পগুলো থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করতে শেখা। সেটা করতে পারলেই সম্ভবত মানুষ মিথ বা ফিকশনের জন্য নিরেট বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে না কিংবা তাকে ধ্বংস করতে উন্মুখ হয়ে উঠবে না, তা সে হোক প্রকৃতি কিংবা মানুষসহ প্রকৃতিতে থাকা অপরাপর প্রাণ।
মিজানুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা