মিয়ানমার, সু চি, আর্মি ও রোহিঙ্গা

  • মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমারে রাজনৈতিক পালাবদলে আর্মির ক্ষমতা দখল। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে রাজনৈতিক পালাবদলে আর্মির ক্ষমতা দখল। ছবি: সংগৃহীত

মিয়ানমারে রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে আর্মির ক্ষমতা দখলের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগী দেশটি থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা অং সান সুচির ক্ষমতাচ্যুত ও আটক হওয়ার খবরে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল। তবে, সদ্য বহাল সামরিক শাসনের কারণে  তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়েও তারা উদ্বিগ্ন। কেননা, মিয়ানমান আর্মি আগাগোড়াই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগও রয়েছে মিয়ানমান আর্মির ললাটে।

পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রত্যুষে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে আটকের পর ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। সেনা কর্তৃপক্ষ পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জরুরি অবস্থাও জারি করেছে। সেখানে চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও  অং সান সুচির আটকের খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যে প্রকাশ, সুচির আটকে বেজায় খুশি বাংলাদেশে  আশ্রিত রোহিঙ্গারা। এমনকি, সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরের বিভিন্ন অংশে আনন্দমিছিল হয়েছে এবং রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মিষ্টিমুখ করেছে।

রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেনের বরাতে প্রকাশ, সোমবার সকালে অং সান সুচি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছে  এ ধরনের খবরে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার ভিত্তিক গণমাধ্যমে চোখ রাখে। দুপুরের দিকে অং সান সু চি আটক ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের খবর নিশ্চিত হলে তারা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ক্যাম্পের অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে  আনন্দমিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

হামিদ হোসেন ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতে, অং সান সু চির কারণে রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে এক কাপড়ে বিতাড়িত হয়েছে। অথচ একটা সময় রোহিঙ্গারা মনে করতো সুচি ক্ষমতায় এলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে।

অথচ বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সু চি বরং রোহিঙ্গা নিধনে সেনাবাহিনীর নারকীয় তৎপরতাকে সমর্থন করেছেন। নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখেন তিনি। রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি বিন্দুমাত্র সমর্থন ও সমবেদনা ছিলনা সুচির। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সুচির পতনে রোহিঙ্গারা খুশি হয়েছে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই খুশি তাদের উদ্বাস্তু ও 'রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন' অবস্থানের আদৌ কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারবে? নাকি রোহিঙ্গা বিরোধী মিয়ানমার আর্মির ক্ষমতা দখলের কারণে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে আরো বিপর্যয় নেমে আসবে? এসব প্রশ্নই এখন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের বেশি করে ভাবাচ্ছে।

অনেকেই মনে করছেন, মিয়ানমান আর্মি তার চিরাচরিত রোহিঙ্গা বিরোধী অবস্থান থেকে হঠাৎ সরে আসবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আর্মি যে জাতি, ধর্ম ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে, সে স্বার্থেই তারা রোহিঙ্গাদের নির্মূল প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে। 

অন্য দিকে কেউ কেউ মনে করেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কারণে বৈধতার প্রশ্নে দুর্বল থাকায় আর্মি মানবাধিকার লঙ্ঘনীয় জাতিগত নিধনে জড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে আরো নাজুক করবে না। আপাতত একটি 'গুড ইমেজ' তৈরির জন্য তারা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নমনীয় হবে।

দেশের ভেতরে ও বাইরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমান আর্মি কোন পথে চলবে, তা হয়ত অচিরেই স্পষ্ট হবে। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইস্যুতে কিছু বিঘ্ন, বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রিতার আলামত ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। খবরে প্রকাশ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মধ্যস্থতায় ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনিশ্চিত হয়ে গেছে।

ফলে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর দ্বারা ক্ষমতা দখল ও সুচির আটকের ঘটনায় খুশি বা উৎফুল্ল হয়ে আনন্দমিছিল ও মিষ্টিমুখ করলেও বিদ্যমান দুর্দশার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার মতো পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামনে এখনো আসেনি। বরং আবার সামরিক শাসনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপদাপন্ন সামগ্রিক পরিস্থিতি  আরো চরম হয়ে 'ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন'-এর পর্যায়ে চলে যায় কিনা, সেটাই ভয়ানক ভয়ের বিষয়।