ধারাবাহিক দুর্ঘটনা, বোয়িংয়ের প্লেন কতটা নিরাপদ
যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের একটি প্লেনের মাঝ আকাশে দরজা ভেঙে পড়ার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। আলাস্কা এয়ারলাইন্সের বোয়িং ম্যাক্স ৯ গত শনিবার (৬ জানুয়ারি) পোর্টল্যান্ডের ওরিগন থেকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়োজাহাজের অব্যবহৃত একটি দরজা (ডোর প্লাগ) ভেঙে পড়ে।
এই ঘটনার পর বোয়িং উড়োজাহাজে বিশেষ করে ম্যাক্স ৯ মডেলে উড্ডয়ন কতটা নিরাপদ তা নিয়ে যাত্রীদের মনে শঙ্কা ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে শনিবার (১৩ জানুয়ারি) জাপানের আকাশে আরেকটি বোয়িং ৭৮৭-৮ উড়োজাহাজ জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়।
জাপানের তোয়ামা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে নিপ্পন এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজটি মাঝ আকাশে ককপিটের জানালায় একটি ফাটল দেখা দেয়। পরে ৫৯ জন যাত্রী নিয়ে উড়োজাহাজটি পুনরায় ছেড়ে যাওয়া বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে।
এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান চলাচলকারী সংস্থা ১৭১টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড করার নির্দেশ দেয় দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর ফলে বাতিল হয় শতশত ফ্লাইট । আর এতে হাজার হাজার আকাশযাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন।
ওই ঘটনায় উড়োজাহাজের ভেতরের যাত্রীদের মধ্যে ভীতির তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত সবাই নিরাপদে ছেড়ে যাওয়া বিমানবন্দরে ফিরে যেতে সক্ষম হন। ভেঙে পড়া উড়োজাহাজটির অংশটির ওজন ছিল ২৭ কেজি। পরে ওই অংশটির খোঁজ পাওয়া যায়, পোর্টল্যান্ডের এক শিক্ষকের বাড়ির পেছনের আঙিনার বাগানে।
এই ঘটনায় বোয়িংয়ের প্রধান তাদের ভুল স্বীকার করে শতভাগ স্বচ্ছতা বজায় রেখে সমস্যাটি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
কিন্তু বোয়িংয়ের প্রধান নির্বাহীর আশ্বাসের পরপরই কি সব শঙ্কা দূর হয়েছে। আকাশপথে যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন তাদের জন্য পুনরায় একই মডেলের বোয়িংয়ের উড়োজাহাজের ভ্রমণে কতটা নিরাপদবোধ করবেন, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
বিমান চলাচল খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেননা এখন পর্যন্ত বোয়িং উড়োজাহাজটির দরজা খুলে যাওয়ার মূল কারণটি উদঘাটিত হয়নি। এটি উন্মোচিত হলে হয়তো বিষয়টি নিয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তবে এরপরেও সুনির্দিষ্ট এই উড়োজাহাজটিতে ভ্রমণে যাত্রীরা আদৌ আগ্রহী হবেন কিনা তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাটি কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ এয়ারলাইন্স ইউনাইটেড বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৯ পরিদর্শনের সময় ঢিলে হয়ে যাওয়া স্ক্রু পেয়েছে বলে জানা গেছে এবং ওই স্ক্রুগুলো পুনরায় শক্তভাবে লাগানো অবস্থায় থাকা প্রয়োজন ছিল মন্তব্য করেছে। এয়ারলাইন্সটি জানায়, তাদের গ্রাউন্ডেড হওয়া উড়োজাহাজগুলো পুনরায় চলাচলের উপযোগী করার আগে দরজার প্লাগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে।
অর্থাৎ ঘটনাটি এখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ পাওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শনিবার তারা প্রাথমিক পরিদর্শন শুরু করেছে। এরপর তারা দরজার প্লাগ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত ইস্যু দেখতে পেয়েছে। পরিদর্শক দল এসব দরজার স্ক্রুগুলো আরও শক্ত করা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে।
বোয়িংয়ের ৭৩৭ উড়োজাহাজের নিরাপত্তা ইস্যুটি আলাস্কা এয়ারলাইন্স বা নিপ্পন এয়ারওয়েজের এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।
২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ অবতরণের পর উইন্ডশিল্ডে ফাটলের ঘটনা ধরা পড়ে। লিজে আনা এই উড়োজাহাজটি আকাশে থাকা অবস্থায় এই ঘটনা ঘটলে বড় দুর্ঘটনা হতে পারতো।
এর আগে, ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ায় বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স উড়োজাহাজের দুটি পৃথক দুর্ঘটনায় ৩৪৬ জন যাত্রী নিহত হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারলাইন্সের বোয়িং উড়োজাহাজটি জাভা সাগরে বিধ্বস্ত হয়ে ১৮৯ জন যাত্রী প্রাণ হারায়। আর ২০১৯ সালের মার্চে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের আরেকটি বোয়িং বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান ১৫৭ জন যাত্রী। এরপর বোয়িং কোম্পানি ম্যাক্স মডেলের উড়োজাহাজের উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।
সেই দুটি দুর্ঘটনার ঘটনা যখন মানুষ ভুলতে বসেছিল তখনই আলাস্কা এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৯ উড়োজাহাজের দরজা খুলে পড়ে যাওয়া নিয়ে বিমান চলাচল খাতে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বোয়িংয়ের পক্ষে পুনরায় বিশেষ করে ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজে আস্থা ফিরিয়ে যাত্রীদের নিরাপদে ভ্রমণের নিশ্চয়তা দেওয়া একটু কঠিনই হবে বলে মনে করছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।