বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। ভারত ও বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন- তা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। যার মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, ভারত থেকে শেখ হাসিনার বক্তব্য, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড এবং জেলেদের প্রতি দুর্ব্যবহার, সেইসাথে আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়গুলো।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সংবাদমাধ্যমটি এক প্রতিবেদনে এই খবর জানায়।
এর আগে ওমানের রাজধানী মাস্কাটে অষ্টম ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে গত রোববার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সাক্ষাৎ হয়। এর পরের দিনই দ্য হিন্দুকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন এক ধরনের সম্পর্কে অভ্যস্ত ছিল এবং হঠাৎ করেই খুব দ্রুত সেটি ভেঙে পড়ে। হয়তো নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগেছে, তার সম্পর্কে বৈরি মনোভাব এবং অস্বস্তি অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমি মনে করি ছয় মাস পরে, এটি আসলে শেষ হওয়া উচিত এবং আমাদের এমন একটি পরিবেশ দরকার যেখানে আমরা একে অপরের সাথে কাজ করতে পারি। ছয় মাস আগের তুলনায়, অবশ্যই আমরা এখন একে অপরের সাথে আরও ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারি।’
ওয়াশিংটনে ট্রাম্প-মোদির বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারত যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, তা নিয়ে জয়শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তৌহিদ বলেন, ‘আসলে তা নয়। আমি জিজ্ঞাসা করিনি কারণ এটি ভারতের ব্যাপার। আমি মনে করি না খুব বেশি উদ্বেগ থাকা উচিত। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত, যা ইতোমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্যে। বাণিজ্যে স্বল্প সময়ের জন্য কিছুটা সমস্যা ছিল, কিন্তু তা আবার বেড়েছে।’
সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলিম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মতোই সমান নাগরিক। তারা সম-অধিকার এবং একই রকম সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারসম্পন্ন নাগরিক। এবং এটা বাংলাদেশ সরকারের কাজ, তারা এটা করছে, দেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই তাদের (সংখ্যালঘুদের) সুরক্ষা দেওয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ‘তার (হাসিনা) বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে আমরা ভারতকে তাকে পাঠাতে বলেছি। যতক্ষণ না ভারত সরকার এটি না করছে, আমরা আশা করব যে- তারা অন্তত তার ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে যাতে তিনি উস্কানিমূলক এবং মিথ্যা বিবৃতি না দিতে পারেন যা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে, কারণ বিষয়গুলো এখনও খুব তরতাজা।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয়ে তৌহিদ বলেন, ‘২০২৪ সালে সীমান্তে ২৪ জনকে গুলি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এটা করা হয় না। ভারতের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয় যে যেহেতু অপরাধ আছে, তাই এটা ঘটছে। বিশ্বের প্রতিটি সীমান্তে অপরাধ আছে। কোথাও এভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় না।’
আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চুক্তির শর্তাবলী পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যদি উভয় পক্ষ সম্মত হয়, তাহলে বিষয়টি যৌক্তিকভাবে পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব।’
বাংলাদেশে আটক ভারতীয় জেলেদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তৌহিদ বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই তদন্তের জন্য অনুরোধ করেছি, এবং যদি আমরা দেখতে পাই যে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর কেউ জড়িত ছিল, অথবা তারা আইন ভঙ্গ করেছে, তাহলে অবশ্যই আমরা তা বিবেচনা করব।’
প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত দুই নেতা একই দিনে কোনো একটি জায়গায় ছিলেন না, তাই তাদের সাক্ষাতের কোনো সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে, উভয়পক্ষেরই সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা এবং মুক্ত মনে ও খোলামেলাভাবে আলোচনা করার আগ্রহ আছে। তবে বৈঠকের ব্যাপারে কোনো মতৈক্য হয়নি। এটা এখনো তেমন পর্যায়ে যায়নি। কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়ে গেলে এবং সম্পূর্ণ হয়ে গেলে, আমরা কয়েক দিন আগে এই বিষয়গুলি ঠিক করি। দেখা যাক কী হয়।
তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু।