কে এই জেনারেল কাসিম সোলাইমানি? 

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জেনারেল কাসেম সুলাইমানি, ছবি: সংগৃহীত

জেনারেল কাসেম সুলাইমানি, ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত ও সমর-কৌশলগত পরিস্থিতিতে ব্যাপক আলোড়িত ইরানি জেনারেল কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনা নতুন বছরের শীর্ষ শিরোনাম হয়েছে। দেশে-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন এই ইরানি সেনাপতি। সবাই জানতে চাচ্ছে, কে এই কাসিম সোলাইমানি এবং কেন তাকে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে?

 
  

মধ্যপ্রাচ্য ও বর্তমান বিশ্বের সামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ছিলেন কাসিম সুলাইমানি। তাকে বিবেচনা করা হয় সমকালীন দুনিয়ার অন্যতম সেরা, কুশলী ও সফল সামরিক কমান্ডার হিসাবে। যুদ্ধকৌশল ও বিজয় নিশ্চিত করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও যোদ্ধাদল গঠনের মাধ্যমে তিনি বাজিমাৎ করতে সক্ষম ছিলেন। শুধু ইরান নয়, ইরানের ভূ-রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আশেপাশে সফলভাবে বিস্তৃত করতে তার রয়েছে বিরাট কৃতিত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক ভূমিকা। 

মধ্যপ্রাচ্য সম্ভবত সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি পাড়ি দিচ্ছে বর্তমানে। চারটি জাতি গোষ্ঠী এখানে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সরব রয়েছে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। সৌদি নেতৃত্বে আরবগণ, তুরস্কের নেতৃত্বে তুর্কিগণ, ইরানের নেতৃত্বে পারসিকগণ এবং রাষ্ট্রহীন কুর্দিরা লড়ছে একে অপরের বিরুদ্ধে।

জাতিগত বিভাজনের বাইরে মতাদর্শিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে তীব্র মেরুকরণ বিরাজমান। তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেন তৎপর ও সম্পৃক্ত আছে তেল, সম্পদ লুণ্ঠন ও অস্ত্র বিক্রির ধান্দায়।

এমন জটিল ও সংকটময় পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি ছায়াযুদ্ধে সাফল্যের প্রধান রূপকার ছিলেন জেনারেল সুলাইমানি। ইরানের আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক কর্তৃত্ব এসেছে মূলত তারই হাত ধরে।

সুলাইমানিকে গণ্য করা হয় সিরিয়ার শিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ত্রাতা হিসাবে। সামগ্রিক বিরোধিতা ও আক্রমণের মুখেও আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার মূল কলকাঠি ও সামরিক কৌশল ঠিক করতেন সুলাইমানি। 

লেবাননে শিয়া মিলিশিয়াদের পুনর্গঠন ও প্রতিআক্রমণে শক্তিও জুগিয়েছেন এই ইরানি জেনারেল। হামাস-হিজবুল্লাহকে একটি দুর্ধর্ষ মিলিশিয়া বাহিনীতে রূপান্তরের পেছনে তার নির্দেশিত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্য কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

ইরাকে সাদ্দামের পতনের পর শিয়া গোষ্ঠীকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার পেছনেও অবদান রয়েছে জেনারেল কাসিম সোলাইমানির। শুধু তাই নয়, বিশাল মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশের শিয়া রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে তিনি প্রশিক্ষিত, সশস্ত্রভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং নানা দেশের শিয়া স্বার্থে এক হয়ে লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুত করেছিলেন। যে কারণে সংখ্যালঘু হয়েও আসাদ সরকার আশেপাশের শিয়াদের অংশগ্রহণে সামরিক শক্তি বাড়াতে ও ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। 

জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কর্তৃত্ব ও শিয়া মতাদর্শ বিকাশকারী এই জেনারেলের হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি মহাঘটনা এবং এ মূহুর্তে এটি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাফল্য বলে বিবেচিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্ররাও এর ফলে সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইরানবিরোধী সফলতা স্থায়ী হবে কিনা এবং ইরান ও শিয়া আধিপত্য খর্ব হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। 

কারণ, কাসিম সোলাইমানি বছরের ওর বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে যে সামরিক ভিত্তি ও যোদ্ধা বাহিনী তৈরি করেছেন, তা সহজেই নিঃশেষ হয়ে যাবেনা। বিশেষত আদর্শিক মনোবল ও উন্নত অস্ত্র দিয়ে তৈরি শক্তিকে নিমেষেই পদানত করা সম্ভব হবেনা। উপরন্তু ইরান এই জেনারেলের মৃত্যু ঝুকি ও বিপদের মুখে বার বার বলেছে, 'আমাদের অনেক কাসিম সোলাইমানি আছে।'

আরও অনেক সুদক্ষ জেনারেল থাকলেও কাসিম সোলাইমানি যে বিশিষ্টতা, নিজ পক্ষের প্রশংসা আর প্রতিপক্ষের নিন্দা পেয়েছেব, এমনটি সবার ভাগ্যে জুটে না। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে কাসিম সোলাইমানি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধে অংশ নেন। সামরিক দক্ষতা ও দৃঢ়তার কারণে পদোন্নতির এক পর্যায়ে ১৯৯৮ সালে তিনি ইরানের অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিকভাবে বিশ্বস্ত বিপ্লবী গার্ডের কুদ্স ব্রিগেডের কমান্ডার হন। দেশের বাইরেও তিনি সাফল্য দেখিয়েছেন। আফগান-ইরান সীমান্তে দায়িত্ব পালনের সময় মাদকপাচার নিয়ন্ত্রণে তিনি বিরাট ভূমিকা পালন করেন। 

ইরাক, আফগান সীমান্ত ছাড়াও সুলাইমানির তৎপরতা ইরানের বাইরে লেবানন ও সিরিয়ায় পরিব্যাপ্ত। ২০০৮ সালে ইরাকি সেনাবাহিনী ও মুক্তাদা আল-সদরের অনুগত মাহদি বাহিনীর মাঝে যুদ্ধের উপক্রম হয়, তখন সুলাইমানি মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেন।

২০১১ সালে সুলাইমানি মেজর জেনারেল হতে জেনারেল পদে উন্নীত হন। এ সময় আলি খামেনী তাকে 'জীবিত শহীদ' উপাধি দেন।

বিজ্ঞাপন

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি প্রভাব বিস্তারের মূল কারিগর রূপে সুলাইমানিকে তখন থেকেই বিশ্ব চিনতে থাকে। আপাত দৃষ্টিতে রক্ষণশীল ইরানের ভেতরের খবর বাইরে খুব একটা না আসলেও নানামুখী সামরিক দায়িত্বের কারণে তার নাম চাপা থাকেনি।

ইরানের বাইরের প্রতিটি দেশে বিশেষ ভূমিকার জন্য সুলাইমানিকে নানা উপাধিও সাধারণ মানুষের পক্ষ ৎেকে দেওয়া হয়। ইরাকের শিয়াদের মুক্তিদাতা বা আসাদের ত্রাতা ছাড়াও তাকে লেবাননের হিজবুল্লাহ-এর সামরিক উইং-এর কার্যকরী প্রধান বলে গণ্য করা যায়। ২০১২ সালে তিনি নিজে সিরিয়ান হিজবুল্লাহ-এর নেতৃত্ব দিয়ে রণাঙ্গনে বাশার-বিরোধী সুন্নি বাহিনীগুলোকে নির্মূল করেন। আল-কাসির এর যুদ্ধে সুলাইমানিকে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। 

ইরাককে আইএসমুক্ত করার লড়াইয়েও সুলাইমানি কার্যকর সামরিক ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত মুসেল ও ফাল্লুজা পুনরুদ্ধারে তার অবদাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ তখন এক ইরাকি মন্ত্রী এমনও স্বীকার করেছিলেন যে, 'সুলাইমানি না হলে হায়দার এবাদির সরকার প্রবাসী সরকারে পরিণত হত আর ইরাক হত অস্তিত্বহীন।' 

এভাবে সুলাইমানি এক সামরিক মিথে পরিণত হন। আরবরা যেভাবে সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের প্রশংসা করে, তুর্কিরা পাশাদের এবং কুর্দিরা সালাউদ্দিনের গুণগানে মুগ্ধ হয়, তেমনি সুলাইমানি পরিণত হন ইরানি বীরে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জলন্ত পরিস্থিতিতে তার ভূমিকা বা নাম নানা প্রসঙ্গে আলোচিত হতে থাকে।

ফলে সুলাইমানি যে প্রতিপক্ষের টার্গেট হবে, এ কথা বলাই বাহুল্য। ইরানিরাও তাকে যুদ্ধ ময়দানে প্রাণ হাতে লড়াইকারী 'জীবন্ত শহীদ' মনে করতো। তার মৃত্যু নিঃসন্দেহে ইরান বিরোধী শিবিরকে স্বস্তি দিয়েছে এবং ইরানকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিক্ষুব্ধ ইরানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তার মৃত্যুর পর পরই প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

 

জেনারেল কাসিম সোলাইমানির হত্যার ঘটনাটি জানতে একটু পেছনে তাকানো যেতে পারে। অতি সম্প্রতি মার্কিন নাগরিক হত্যার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও সিরিয়ার কয়েকটি হিজবুল্লাহ ঘাঁটিতে বিমান হামলা করে। এতে প্রায় ত্রিশজন নিহত হয়। জবাবে উত্তেজিত হিজবুল্লাহ সমর্থকরা বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই উত্তেজনার সুযোগে মার্কিনীরা আক্রমণের সুযোগ পায় এবং তাদের আপাতত বড় সাফল্য বাগিয়ে নেয়। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) অতিপ্রত্যুষে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন বিমান হামলা চালিয়ে জেনারেল সুলাইমানিকে হত্যা করে। ধারণা করা হচ্ছে, সুলাইমানির অবস্থান নিশ্চিত করে এই হামলা চালানো ও তাকে নিহত করা হয়। 

বিদ্যুৎ বেগে তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে গেলে শুধু ইরান নয়, সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তার মৃত্যুতে যুগপৎ শোক ও আনন্দ প্রকাশ পায়। মার্কিন, ইসরায়েল বা পশ্চিমা বিশ্বের আনন্দ ও স্বস্তির পাশাপাশি আরব বিশ্বের সুন্নি সম্প্রদায়েও খুশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, সুলাইমানির যুদ্ধ কৌশল ও আক্রমণে অকাতরে সুন্নির মৃত্যু হয়েছে। আরব বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিরা কোণঠাসা ও আক্রান্ত হয়েছে এবং ইরানের নেতৃত্বে শিয়া আধিপত্য লেবানন, সিরিয়া, ইয়ামেন হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়েছে। 

অন্যদিকে ইরানে জাতীয় শোকের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। ইরান তাদের এই জাতীয় বীরের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার সঙ্কল্প জানিয়েছে। ফলে তার মৃত্যু শান্তির বদলে বদলার রাজনীতিকেই প্রলম্বিত করবে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ইরানের নেতৃত্ব যে 'শিয়া ক্রিসেন্ট' উদিত হয়েছে, তাতে শিয়া প্রাধান্য ও আধিপত্য স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেনারেল কাসিম সোলাইমানির নেতৃত্বে শিয়া অগ্রযাত্রা ব্যাপকভাবে শক্তি সঞ্চয় করে বিস্তৃত হয়েছে। প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করে সুলাইমানি রণাঙ্গনকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিজের বিজয়ের পক্ষে। 

ইসলামের ইতিহাস নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে প্রাথমিক যুগ থেকেই রক্তাক্ত লড়াইয়ের মতাদর্শিক ধারা লক্ষ্য করা যায়। ভ্রাতৃঘাতী এই লড়াইয়ে একে অপরের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও নিপীড়নের ইতিবৃত্তও লিপিবদ্ধ হয়েছে। লেখা হয়েছে অনেক বীর ও সেনাপতির নাম। কে সঠিক আর কে ভ্রান্ত, সে বিচারের আগে বরং আত্মঘাতী বেদনা, রক্ত, প্রাণনাশের ছবিই সবার আগে সামনে চলে আসে।

ইসলামের ঐতিহাসিক লড়াইয়ে যে তালিকায় একবিংশ শতকের প্রেক্ষাপটে অবশ্যই যুক্ত হবে জেনারেল কাসিম সোলাইমানির নামও।

বিজ্ঞাপন