দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক মসজিদ
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। রাজধানীর নাম কলম্বো। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। সিংহলি সম্প্রদায় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। শ্রীলঙ্কা চা, কফি, নারকেল, রাবার উৎপাদন ও রফতানিতে বিখ্যাত। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সমুদ্রসৈকত ও ভূদৃশ্য শ্রীলঙ্কাকে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পৃথিবীতে শ্রীলঙ্কা একমাত্র অমুসলিম দেশ, যেখানে রেডিও-টেলিভিশনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেওয়া হয়।
শ্রীলঙ্কা এক সময় নিয়ন্ত্রণ করতো পর্তুগিজ এবং ডাচরা। এরপর শাসন করে ব্রিটিশরা। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে।
৬৫৬০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের শ্রীলঙ্কায় প্রায় পৌনে তিন কোটি জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠী। এ ছাড়া মুসলিম ১০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা মুর নামে পরিচিত। তারা দেশটিতে তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত সম্প্রদায়।
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দেশজুড়ে রয়েছে আড়াই হাজারের বেশি মসজিদ। শুধু রাজধানী কলম্বোতে মসজিদের সংখ্যা শতাধিক।
শ্রীলঙ্কার মসজিদগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হলো- লাল মসজিদ। অভিনব স্থাপত্য শৈলী এবং সৌন্দর্যের কারণে প্রতিদিন শতশত পর্যটক মসজিদটি দেখতে আসেন। রাজধানী কলম্বোর এই মসজিদের আসল নাম জামিউল আলফার। শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী লাল রং দিয়ে মসজিদের দেয়াল অলঙ্করণের জন্য পরবর্তীতে নামকরণ করা হয়েছে- লাল মসজিদ। মসজিদ নির্মাণের সময়কাল ১৯০৮-০৯ সাল। মসজিদের বয়স ১১০ বছেররও বেশি।
১৭-১৮ শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীরা আসেন শ্রীলঙ্কায়। তাদের নামাজ, ইবাদত-বন্দেগি ও বিশ্রামের তাগিদ থেকে ১৯০৮ সালে নির্মাণ করা হয় মসজিদটি। মসজিদটির নকশা করেন দক্ষিণ ভারতীয় এক স্থপতি। নকশার সময় তিনি ডালিমকে মূল নকশায় রাখেন। এই মসজিদের মিনারগুলোর আকৃতি দেখতে অনেকটা ডালিমের মতো। শুধু তাই নয়, ডালিমের লাল এবং সাদাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মসজিদের রঙে। এর প্রতিটি ইটে আলাদাভাবে লাল এবং সাদা রং করা হয় নিয়মিত।
শুরুতে ছোট পরিসরে নির্মাণ করা হলেও পরে বড় করা হয় মসজিদের আয়তন। ছয় তলা বিশিষ্ট এই মসজিদটি শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় মসজিদ। পুরো মসজিদই ব্যবহৃত হয় নামাজের জন্য। এই মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ১৬ হাজার।
লাল মসজিদ ইসলামি স্থাপত্যের এক বিস্ময়। মসজিদের গড়ন দেখতে অনেকটা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের জামে মসজিদের মতো। মসজিদের পাশে নানান রকম তৈজসপত্র থেকে শুরু করে বাহারি কার্পেট, জায়নামাজ, টুপি, আতর ও সুগন্ধিসহ নানা রকম পণ্যের সমাহার রয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় শতাধিক কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র এবং দুইশ’র মতো মাদরাসা ও স্বতন্ত্র ইসলাম শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। যেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। দেশজুড়ে থাকা এসব মসজিদ-মাদরাসাগুলো বহন করছে মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক।
শুধু লাল মসজিদ নয়, গল ফোর্টের সেন্ট্রাল মসজিদও শ্রীলঙ্কার অন্যতম মসজিদ। এটি ডাচ ফোর্টে মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক বহন করছে। মসজিদের পাশে রয়েছে ‘মুসলিম কালচারাল সেন্টার।’ ভারত মহাসাগরের বিশাল জলরাশির পাশে মসজিদটি হওয়ায় সাগরের স্নিগ্ধ বায়ু উপস্থিত মুসল্লিদের মনপ্রাণ প্রফুল্ল করে তোলে। সাদা, লম্বা এবং উচুঁ মিনারের এ মসজিদটির চারদিক নারকেল গাছ দিয়ে বেষ্টিত। শতাব্দী প্রাচীন এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দেখতেও পর্যটকরা ভীড় করেন। প্রাচীন আরবি স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত মসজিদটি দূর থেকে দেখতে অনেকটা ছবির মতো।
এভাবে কলম্বোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চারতলা বিশিষ্ট কল্লুপেটিয়া জামে মসজিদ, কেন্দ্রীয় কারাগার লাগোয়া বিশাল মালয় মিলিটারী মসজিদ, কুরগালায় দশম শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদ, শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চল ডাম্বুলার ৬০ বছরের পুরোনো মসজিদ উল্লেখযোগ্য। মোটামুটি শ্রীলঙ্কার প্রতিটি শহরের প্রাণকেন্দ্রেই বড় ও সুন্দর মসজিদ রয়েছে। যা ইসলামের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মানুষের ঐহিত্যগত সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি মাদরাসা, মক্তব থাকায় মসজিদের আবাদ হয় ভালোভাবেই। বলা চলে, শ্রীলঙ্কার মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করে রাখছে এসব মসজিদ-মাদরাসা।
শ্রীলঙ্কায় দেওবন্দের অনুসরণে বেশ কিছু মাদরাসাও রয়েছে। দেশটির অনেক মুসলমান তাবলিগের কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাবলিগের মারকাজ গ্র্যান্ডপাস রোডের মসজিদটিও বেশ বিখ্যাত। বাকীরাও বেশ ধর্মপরায়ণ। শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের মাঝে সুফিবাদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গলের সাংবাদিক ফারহান নিজামউদ্দিনের মতে, রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কান মুসলিম কংগ্রেস বেশ প্রভাবশালী। অন্য রাজনৈতিক দলেও মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার মুসলমান শ্রীলঙ্কা থেকে হজপালন করেন।
কলম্বোর মুসলিম সংগঠন ন্যাশনাল শুরা কাউন্সিলের নেতা আজমান আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রচুর সামাজিক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যা তাদের দিয়েছে আলাদা পরিচিতি।