বন্ধু যেন দুনিয়া ও আখেরাত নষ্টের কারণ না হয়
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘জালেম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের সঙ্গে পথ অবলম্বন করতাম! হায়, আমার দুর্ভাগ্য, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোঁকা দেয়।’ -সূরা ফুরকান: ২৭-২৯
আয়াতগুলো বিশেষ একটি ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এর বিধান ব্যাপক। ঘটনাটি হলো, উকবা ইবনে আবি মুআয়িত মক্কার অন্যতম মুশরিক সর্দার ছিল। সে কোনো সফর থেকে বাড়ি ফিরলে শহরের সম্মানিত ব্যক্তিদের দাওয়াত করে খাওয়াত। মাঝে-মধ্যে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করত। একবার সে কোনো এক সফর থেকে ফিরে রীতি অনুয়ায়ী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়ার করল এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) কেও দাওয়াত করল। কিন্তু হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার বড়িতে খাবার খেতে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। তবে শর্ত দিলেন, যদি সে ঈমান আনে কালিমা পড়ে তবে খাবার খাবেন। শর্ত মোতাবেক উকবা ইবনে আবি মুআয়িত নবীজির কাছে কালেমা পড়ল। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) শর্তপূরণে খাবার খেলেন। এদিকে উকবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল উবাই ইবনে খলফ। উবাই ইবনে খলফ উকবার ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে খুব নারাজ ও রাগান্বিত হয়। উকবা বন্ধু উবাইকে বলে, মোহাম্মদের (সা.) মতো মানুষ আমার বাড়ি থেকে না খেয়ে গেলে আমার মান যেত, তাই আমি কালিমা পড়েছি। কিন্ত উবাই কোনো আপত্তি শুনতে নারাজ। অবশেষে উবাই ইবনে খলফ বলল, তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক শেষ। তবে হ্যাঁ, তুমি যে মোহাম্মদের কাছে কালিমা পড়েছ; যদি তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করতে পারো- তবে আমাদের বন্ধুত্ব ঠিক থাকবে। হতভাগা উকাব বন্ধুত্ব রক্ষা করতে গিয়ে সত্যি সত্যি মোহাম্মদ (সা.)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। এ প্রেক্ষাপটে আল্লাহতায়ালা এ আয়াতগুলো নাজিল করেন।
কিয়ামতের মাঠে উকবা নিজের হাত নিজেই মুখে দিয়ে দাঁত দিয়ে অনবরত কামড়াতে থাকবে, আর বলবে হায়! যদি আমি উবাইকে বন্ধু না বানিয়ে মোহাম্মদ (সা.)-এর পথ ধরতাম, তাহলে কতোই না ভালো হতো। বর্ণিত আয়াত থেকে শেখার এবং বোঝার আছে অনেক কিছু।
পৃথিবীতে বন্ধু নেই এমন মানুষ হয়ত খুজে পাওয়া যাবে না। বন্ধুহীন আমরা কেউ চলি না। জগত-সংসারে বন্ধুর প্রয়োজনও বটে। বিপদে-আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়াই। মনের আবেগ-অনুভূতি সাধারণত বন্ধুদের কাছেই প্রকাশ করি। তবে বন্ধু গ্রহণের পূর্বে আমাদের ভাবতে হবে বন্ধুর গুণাবলী কেমন হবে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের বন্ধু-অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন আলোর পথে।’ -সূরা বাকারা: ২৫৭
আয়াতে কারিমা থেকে বোঝা যায়, মানুষকে হেদায়েত ও আলোর পথ দেখানো প্রকৃত বন্ধুর কাজ। এখনতো আমাদের বন্ধুরা আমাদের আলো থেকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যায়। সৎ পথ ছেড়ে অসৎ পথে চলার আহ্বান জানায়। এমন বন্ধু দুনিয়া, আখেরাত দু’টোই ধ্বংস করে।
বন্ধুর আবার আছে নানান পদ রয়েছে। ব্যক্তি বন্ধু থেকে শুরু করে, দলীয়, প্রতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধু। বন্ধু যেই হোক, যদি আহ্বান থাকে খারাপের পথে, মন্দের পথে, অন্তরায় সৃষ্টি করে ন্যায় ও ইনসাফের মাঝে। বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রিয় নবীকে ভালোবাসতে। তবে সেই বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নেই। ওই বন্ধুত্ব ছেড়ে ঈমান-আকিদা টিকিয়ে রাখতে হবে।
রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের নামে কয়েকদিন আগে আরব আমিরাত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। শোনা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে আরও কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ইসরাইলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে চলছে। আফসোস ওইসব রাষ্ট্রের জন্য, এমন বন্ধুত্বের জন্য। যে ইসরাইল যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে হামলা করে অসংখ্য মুসলমানকে শহীদ করেছে, নারীদের ইজ্জতহানী করেছে, মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দিচ্ছে- তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব মেনে নেওয়া যায় না। এ বন্ধুত্ব নবীকে ছেড়ে উবাইকে বন্ধু বানানোর প্রতিচ্ছবি! আখেরাতের কথা ভুলে, দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার এমন বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘বস্তুত তোমরা দুনিয়াকেই প্রাধান্য দিচ্ছো। অথচ আখেরাত উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। তবুও কি আমাদের বোধোদয় হবে না!’ -সূরা আলা: ১৬-১৭
মুহাম্মদ হাসান মুরাদ: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম বুজরুকগড়গড়ী, চুয়াডাঙ্গা।