হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর সামাজিক ও মানবীয় চরিত্র
![নবী মুহাম্মদ সা.-এর অনুসরণেই আমাদের মুক্তি নিহিত, ছবি: সংগৃহীত](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2020/Oct/21/1603273141786.jpg)
নবী মুহাম্মদ সা.-এর অনুসরণেই আমাদের মুক্তি নিহিত, ছবি: সংগৃহীত
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হজরত স্ত্রী খাদিজা (রা.) কে হেরা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া অহি ও জিবরাইল সংক্রান্ত ঘটনাগুলো উল্লেখপূর্বক ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আমার জীবন সম্পর্কে আশঙ্কা করছি।’ হজর খাদিজা (রা.) সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তা কখনও হতে পারে না, তিনি (আল্লাহতায়ালা) আপনাকে অপদস্থ করবেন না। ১. আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সংরক্ষণ করেন, ২. আপনি দুস্থ মানুষের বোঝা হালকা করেন, ৩. নিঃস্বদের আহার করান, ৪. অতিথিদের সেবা করেন ও ৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের সাহায্য করেন।’ –সহিহ বোখারি
এগুলো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে হজরত খাদিজা (রা.)-এর উক্তি। তিনি নবী করিম (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী। উম্মতের মধ্যে প্রথম ঈমান আনয়নকারী, জগতের শ্রেষ্ঠতম চার রমণীর অন্যতম। তিনি তার সব ধনসম্পদ রাসূলের কদমে উৎসর্গ করেছেন। রাসূলের সব ছেলেমেয়ে তার গর্ভে জন্মলাভ করেন। অহি লাভের পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অস্থিরতায় তিনি সান্তানা দিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।
একজন স্ত্রীর মন্তব্য স্বামীর ব্যাপারে খুবই প্রণিধানযোগ্য। কারণ সুখে-দুঃখে, দিনে-রাতে, সকালে-বিকেলে, রাগ-বিরাগে সর্বাবস্থায় নিবিড়ভাবে স্বামীকে দেখার সুযোগ পান তিনি। আর যদি স্ত্রী হন অতীব বিচক্ষণ, সচেতন ও জ্ঞান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন তবে তো কথাই নেই। যে মুহাম্মদকে মক্কাবাসী পূর্বেই আল আমিন বলে ঘোষণা দিয়েছে, নবুওয়তপূর্ব জীবনে বর্বতার মধ্যে সভ্য, অশ্লীতার মধ্যে পরিচ্ছন্ন, পুঁতিগন্ধময়ের মধ্যে সৌরভ, অন্ধকারের মধ্যে আলো হিসেবে দেখছেন। তারপরও সবার প্রশংসার চেয়ে খাদিজার উক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসে হজরত খাদিজা (রা.) আরও বলেছেন, ‘আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সংরক্ষণ করেন।’ এর বাস্তবতা আমরা নবী জীবনের পরতে পরতে দেখতে পাই। এ সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনাও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নবুওয়তের ঘোষণা দেয়ার পরও তিনি এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। কোরআনে কারিমেও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে বহু আয়াত নাজিল হয়েছে।
কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা অধিকার দাবি করো আর সতর্ক থাকো আত্মীয়তার অধিকার ও সম্পর্কের বিষয়ে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন।’ -সূরা নিসা: ০১
হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিন্নকারীরা জান্নাতে যাবে না।’ –সহিহ বোখারি
আজকের সমাজে ভাইয়ে-ভাইয়ে, পিতা-পুত্রে, চাচা-জেঠাদের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক নেই বরং নিকটাত্মীয়রা যেন অন্যদের চেয়েও বেশি শত্রু। সামান্য কারণে ঝগড়া-বিবাদ লেগে যায় এবং তা চলতে থাকে বছরের পর বছর। এই সময়ে রক্তের সম্পর্ক রক্ষা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার জন্য জরুরি।
হজরত খাদিজা (রা.) আরও বলেন, ‘আপনাকে দেখেছি সারাজীবন দুর্বল ও বঞ্চিতদের বোঝা বহন করতে।’ অথচ বাস্তবতা হলো- সমাজের বেশিরভাগ মানুষ দুর্বল ও অবহেলিত। তারা ন্যূনতম মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে না। এই শ্রেণির লোকেরা সবসময় স্বল্পসংখ্যক সুবিধাভোগীর হাতে নিপীড়িত হয়। স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের অন্তর্ভুক্ত। সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি সামান্য অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছেন। ইমাম বোখারি (রহ.) এমন একটি হাদিসও উল্লেখ করেছেন। আর আল্লাহতায়ালা এমন কোনো নবী পাঠাননি, যিনি রাখাল ছিলেন না। আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, বেশিরভাগ নবী শ্রমজীবী ছিলেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সারাজীবন এতিম, বেওয়ারিশ ও মিসকিনদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। তিনি এতটুকু বলেছেন, আমার উম্মতের বেশিরভাগ মানুষ গোলাম, শ্রমজীবী ও এতিম হবে। তাদের বোঝা হালকা করার জন্য নিয়োজিতরা জান্নাতি।
কিন্তু আজকের সমাজে কী দেখি? মানুষ কিভাবে জালেমদের অত্যাচারে নির্বাক ও নিথর হয়ে অশ্রুবিসর্জন করছেন।
হজরত খাদিজা (রা.) হাদিসে আরও বলেন, ‘আপনি তো নিঃস্বদের আহারের ব্যবস্থা করেন, আপনি নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেন, আপনি বিবস্ত্রদের কাপড় দেন, আল্লাহতায়ালা অবশ্যই আপনার কল্যাণ করবেন।
‘দরিদ্র, নিঃস্ব ও বুভুক্ষুরা আল্লাহর পরিবারের সদস্য’ বলে হাদিসে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে হাদিসে কুদসিতে, আল্লাহ বলবেন কিয়ামতে- ‘হে বনি আদম! আমি ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার নিকট গিয়েছিলাম তোমরা আমাকে খাবার দাওনি, লোকেরা বলবে তুমিতো আহার করো না, কিভাবে তোমায় আহার করাবো? আল্লাহ বলবেন, ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা হলে আমাকে খাদ্য দেওয়া হতো।’ –সহিহ মুসলিম
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসূলের জবানে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘তারা মুমিন নয়, যারা প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে আহার করে।’ মিশকাত
নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রতিবেশীদের খবর না নিয়ে, আসহাবে সুফফার লোকদের আহারের ব্যবস্থা না করে খাবার মুখে দেননি।
এখন তো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দু’বেলা আহার করতে পারে না, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের মুখে অন্ন ও পরিধানের বস্ত্র ও আর্তের চিকিৎসার জন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মনীতি কী ছিল? আমরা কোথায়, কী করছি, কোন ইবাদাতের মধ্যে জান্নাত খুঁজছি- এসব চিন্তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানবতার সেবায়ই রয়েছে, আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি।
হজরত খাদিজা (রা.) আরও বলেন, ‘আপনি অতিথির সেবা করেন।’ কাবা শরীফ মক্কায় অবস্থিত বিধায় হাজার হাজার বছর থেকে কাবাকেন্দ্রিক বিভিন্ন এলাকা ও জনপদ থেকে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাতো। কোরাইশ পৌত্তলিকেরা বিদেশিদের জীবন সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব করত বিশেষ করে হজ মৌসুমে। যদিও জাতিগতভাবে আরবিরা অতিথিপরায়ণ কিন্তু অসৎদের আর মূল্যবোধের বালাই থাকে না।
নবী মুহাম্মদ (সা.) বাল্যকাল থেকে অসহায় বিদেশি ও অতিথিদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠনের দৃশ্য দেখে আসছিলেন। হিলফুল ফুজুল সংগঠন সৃষ্টির উদ্দেশ্যও ছিল সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিদেশিদের নিরাপত্তা দেওযা।
নবী করিম (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘কেউ যদি আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান আনে, সে যেন অতিথির সেবা করে।’ –সহিহ বোখারি
‘সত্যের পথে নির্যাতিতদের আপনি সাহায্য করেন’ হজরত খাদিজা (রা.)-এর এই উক্তিটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। হক ও ন্যায়ের পথে যারা যে যুগেই চলতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর সমাজ তাদের চলার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে জুলুম-নিপীড়ন নির্যাতনের বিষাক্ত কাঁটা মাড়িয়ে চলতে হয়েছে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে (মুমিনদের) ভয়-ভীতি, ক্ষুধা, ধনসম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব, তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও, যারা যেকোনো বিপদ-মুসিবতে বলে আমরা আল্লাহর কাছ হতে এসেছি এবং তারই নিকট ফিরে যাব।’ -সূরা বাকারা: ১৫৫
বস্তুত নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সামাজিক ও মানবীয় চরিত্র যা হজরত খাদিজা (রা.) বর্ণনা করেছেন, এগুলো উম্মতের জন্য শিক্ষা ও গ্রহণী বিষয়।
সুতরাং আমাদেরকে সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত মজলুমদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। দরিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তাদেরকে সমাজের মূলস্রোতে আনতে চেষ্টা করতে হবে। নিরন্নদের মুখে অন্ন তুলে দিতে হেব। এগুলোকে ইবাদত মনে করতে সম্পাদন করতে হবে।
সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি অতিথি, পরিচিত-অপরিচিত সবার প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে। এটা মানবতার পরম শিক্ষা।