প্রকৃত মুসলিমের যেসব গুণ থাকতে হবে

  • মাহমুদা নওরিন, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অর্থ : ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে’

অর্থ : ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে’

মুসলমানদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা পালনে উদাসীনতা ও সবক্ষেত্রে দুনিয়ার স্বার্থ খোঁজার প্রতিযোগিতার কারণে মানুষের আচার-আচরণে বড় ধরনের স্খলন লক্ষ করা যাচ্ছে। তাই মুসলিম সমাজে এখন অভদ্রতা, অপরকে গালমন্দ করা, দমিয়ে রাখা, তুচ্ছ জ্ঞান করা, পরনিন্দা, গীবত, দুর্নীতি, অর্থোপার্জনে প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, হিংসা, অহংকার, লোভ ইত্যাদি পরস্পরের প্রতি প্রচলিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এ জাতীয় বদঅভ্যাসের লোকেরা প্রকৃত মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না।

প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি যখন কোরআন-হাদিসের আলোকে জীবনযাপন করে, তখন তার জীবন দুনিয়ার অন্যসব মানুষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রূপ পরিগ্রহ করে। তার জীবন হয় সুন্দর, নিষ্কলুষ, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ। এরূপ সুন্দর নিষ্কলুষ পরিশুদ্ধ মানুষের লেনদেন, আচার-আচরণ, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনচর্চার মধ্যে কোথাও কোনো অরুচিকর, অশ্লীল, অন্যায়, অবৈধ, গর্হিত কোনো বিষয় স্থান পেতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

এভাবে একজন মুসলিমের কথা-কাজ ও চিন্তার সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিণত হন একজন পরিশুদ্ধ মানুষে। একজন সত্যিকারের মুসলিম হবেন পরিপূর্ণ একজন ভালো মানুষ। তিনি ইবাদতের ক্ষেত্রে ফরজ-ওয়াজিব গুরুত্বসহকারে পালনের পাশাপাশি আলাদা কিছু গুণের অধিকারী হবেন। সেগুলো হলো-

ভালো কাজে আহ্বানকারী

বিজ্ঞাপন

একজন মুসলমান সব ধরনের বদভ্যাস থেকে মুক্ত থাকবেন- এটাই স্বাভাবিক। অপরের অধিকারের ব্যাপারেও অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন। সত্যিকারের মুসলিম তার আশপাশের মানুষদের সবসময় সত্য ও সুন্দরের দিকে সাধ্যমতো আহ্বান করবেন। সত্য ও সুন্দরের দিকে মানুষকে আহ্বান করা একজন মুসলমানের জন্য অন্যতম ফরজ দায়িত্ব। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করো, অসৎকাজে নিষেধ করো।’ -সুরা আলে ইমরান : ১১০

বিশুদ্ধ ও মিষ্টি ভাষার অধিকারী

সুন্দর ব্যবহার, সুন্দরভাবে কথা বলা সুন্দর মনের পরিচয় বহন করে। মানুষের একটি ভালো কথা যেমন একজনের মন জয় করে নিতে পারে, তেমনি একটু খারাপ ও অশোভন আচরণ মানুষের মনে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে একজন মুসলিম সর্বদা মানুষের সঙ্গে ভালো ও সুন্দর ব্যবহার করবে। যেমন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি প্রতিশোধকামী ছিলেন না, তিনি সহজে ক্ষমা করে দিতেন। তিনি তাকেও ক্ষমা করে দিতেন, যে তাকে অপমান করেছেন। তার মাঝে কোনো অহংকার ছিলো না। কখনও কারও ক্ষতি করেননি এবং অসৎ পথ অবলম্বন করেননি। তিনি ছিলেন অতিথিপরায়ণ। তিনি তার সহকর্মী ও অধস্তনদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করতেন সবসময়। অথচ তিনি ছিলেন অতিশয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ।

আলোকিত সমাজ গড়ার কারিগর

একজন মুসলিম নিজস্ব বিবেক ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে তুলেন। প্রকৃত ঈমানদার তার চরিত্রের যাবতীয় গুণাবলি বিকশিত করেন প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে। তাই মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রং ধারণ করো, আল্লাহর রং আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর?’ -সুরা আল বাকারা : ১৩৮

একজন প্রকৃত মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে, ব্যক্তি সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে গোটাসমাজকে আলোকিত করা, যা দেশ, কাল ও সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে একজন মুসলিম এ কাজ করে থাকেন। কারণ কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘ওঠো, সতর্ক করো এবং তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।’ –সুরা মুদ্দাসসির : ২-৩

অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আমানতদার

ঈমানের প্রধান বিষয় হলো- সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন, যা ক্রমাগত স্বশিক্ষায় নিযুক্ত করে এবং অপরকে সম্মান করতে শেখায়। মানবিক গুণাবলির মধ্যে মানুষকে সম্মান প্রদর্শন করা একটি অন্যতম গুণ। সমাজে নিয়মশৃঙ্খলা, প্রেম-প্রীতি ও শ্রদ্ধা-সম্মানের এ মহৎ গুণের মাধ্যমে শান্তি নেমে আসে সমাজে। ইসলামে তাই অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমাদের রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যারা বড়দের শ্রদ্ধা করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমার উম্মত নন।’ প্রত্যেক মুসলিম যদি এ নির্দেশ পালন করেন, তাহলে তিনি একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে পরিগণিত হবেন। যার কাছে ছোট-বড় সবাই সমান দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। সত্যিকারের মুসলমানের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির সম্পর্ক থাকে না। একজন মুসলিম যার কণ্ঠ ও চরিত্রই হচ্ছে- যাবতীয় অনিয়ম ও অসংগতির বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। সর্বদা অন্যের ওপর আস্থাশীল। দ্বন্দ্ব ও ছলনার ভিত্তিতে জীবন গঠনের চিন্তা করতে পারে না। তিনি পেশাগত জীবনে হন পরিচ্ছন্ন। কেননা হাদিসে আছে, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ -জামে তিরমিজি : ১২০৯

অন্যের প্রতি সুধারণার অধিকারী

একজন মুসলিমের বিবেচ্য বিষয় হবে, অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানো, অপরের অপ্রীতিকর বিষয়ে উঁকি না মারা, কারও বিষয়ে অতি আগ্রহী না হওয়া। তিনি কখনও অপরের নিন্দাকারী হবেন না। একজন মুমিন-মুসলমান অন্যের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে না, কারও অগোচরে মন্দ বলবে না। কারণ সে জানে, ‘যে অন্যের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন।’ -সহিহ মুসলিম : ২৬৯৯

সত্যিকারে দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক

একজন মুমিন-মুসলমান হন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক। আন্তরিকভাবে সে তার দেশকে ভালোবাসে। মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করে। দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশও দিয়েছে ইসলাম। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনেপ্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল। এ অবস্থায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।’ -সহিহ বোখারি