যে কাজে ইবাদত-বন্দেগি কবুল হয় না
মুমিনের সকল আমল, ইবাদত-বন্দেহি আল্লাহতায়ালার জন্য নিবেদিত। সেখানে অন্যকোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। পবিত্র কোরআনে একনিষ্ঠতার সঙ্গে ইবাদত-বন্দেগি করতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তার জন্যই দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও জাকাত প্রদান করে আর এটাই সঠিক দ্বীন।’ -সুরা বাইয়্যিনাহ : ৫
দুনিয়ায় কোনো পার্থিব স্বার্থে রবের ইবাদতকে নিন্দনীয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিরক সাব্যস্ত করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করল সে শিরক করলো, আর যে ব্যক্তি কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা পালন করলো; সে শিরক করলো এবং যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে দান-সদকা করলো সে শিরক করলো।’ -মুসনাদে আহমদ
মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদতের স্থান ইসলামে নেই। যেটাকে প্রদর্শনেচ্ছা কিংবা রিয়া বলা হয়। কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও একনিষ্ঠতা বাদে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হলো- প্রদর্শনেচ্ছা। ব্যক্তি যখন প্রদর্শনেচ্ছার মতো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন কোনো কাজের চেয়ে কাজের প্রচার বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এটাকেই সবচাইতে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। প্রদর্শনেচ্ছায় আক্রান্ত ব্যক্তি সকল কাজে প্রচারকে অগ্রাধিকার দেয় না বরং সে অন্যের ভালো-মন্দের অনুমানকারীতে পরিণত হয়। ইসলাম অনুমানভিত্তিক কথা বলাকে সমর্থন দেয়নি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো। কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গোনাহ। (অন্যের) দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারও গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।’ -সুরা আল হুজুরাত : ১২
ইসলাম যেটাকে মস্ত-বড় অপরাধ বলছে, সেখানে কোনো মানুষ ওই অপরাধকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষ করে একজন মুমিনের জন্য কখনও তা শোভনীয় নয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে তাই দেখাবে অর্থাৎ প্রদর্শনীমূলক আমল করলে তা প্রচার করে দেখানো হবে। সুনাম সুখ্যাতি অন্বেষণের উদ্দেশ্যে যে লোক আমল করবে আল্লাহ তার আমল (দোষ ত্রুটিগুলো) প্রচার করে দেবেন।’ -ইবনে মাজাহ : ৪২০৬
ব্যক্তি যখন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে আল্লাহ তার কর্মের খারাপ দিক ও ত্রুটি প্রচার করেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হিসাব নিকাশের জন্য যে ব্যক্তিদের সর্বপ্রথম ডাকা হবে তারা হলেন- কোরআনের হাফেজ, আল্লাহর পথে শহীদ ও ধনী ব্যক্তি। এই তিনজনই সর্বপ্রথম জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটাই প্রমাণিত হবে যে, তারা দুনিয়াতে নিজেদেরকে বিশেষ নামে পরিচিত করতে বা বিশেষ নামে সবাই ডাকুক এজন্য কোরআনের হাফেজ, শহীদ ও সম্পদওয়ালা হয়েছিল।
ব্যক্তির উদ্দেশ্য যদি নিজের খ্যাতির, প্রচার ও প্রসারের জন্য হয়; তবে সেটা ব্যক্তির জন্য ক্ষতির কারণ হবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআনের পাঠককেও সতর্ক করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর নিকট জুব্বুল হুজন হতে আশ্রয় প্রার্থনা কর। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! জুব্বুল হুজন কী? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তা হলো জাহান্নামের মধ্যকার একটি উপত্যকা, যা থেকে স্বয়ং জাহান্নামও প্রতিদিন শতবার আশ্রয় প্রার্থনা করে। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! তাতে কে প্রবেশ করবে? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যেসব কোরআন পাঠক লোকদেখানোর জন্য আমল করে। -ইবনে মাজাহ : ২৫৬
প্রদর্শনেচ্ছা যেন বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পৃথিবীব্যাপী শ্রেষ্ঠ প্রদর্শনেচ্ছাস্থলে পরিণত হয়েছে। যার কারণে ব্যক্তি পরকালীন ক্ষতির পাশাপাশি দুনিয়াতেও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর অন্যতম হলো-
এক. ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অসন্তোষজনক বা ব্যক্তি ইমেজ সঙ্কটে পতিত হয়।
দুই. প্রদর্শনেচ্ছার কারণে ব্যক্তি নিজের অজান্তেই মিথ্যার লালন করেন। নিজের প্রয়োজনে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ধোঁয়াশায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
তিন. প্রচার ও প্রসার ব্যক্তিকে অস্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত করে। অধিকাংশ সময় কৃত্রিম আচরণ করে।
চার. প্রদর্শনেচ্ছা অধিক ফলপ্রাপ্তিতে উৎসাহ দেয় এবং নিজের কল্যাণই মুখ্য বিষয়ে পরিণত করে। ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সকল ইবাদতের মাধ্যমে অর্জিত বিশেষ যোগ্যতা ও বরকত হতে বঞ্চিত হয়। কবিরা গোনাহের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে।
পাঁচ. প্রদর্শনেচ্ছা যখন কোনো সংগঠিত দলের মাঝে পরিলক্ষিত হয় তখন সে দল মূল লক্ষ্য হতে ধীরে ধীরে সরে আসে। প্রদর্শনেচ্ছা যদি ইসলামি আন্দোলনরত কোনো দলের মাঝে দেখা দেয় তবে সেটা ত্বরিত সমাধান করা বাঞ্ছনীয়। নচেৎ প্রদর্শনেচ্ছার প্রভাবে ইসলাম-পরিপন্থী বিধান হয়ে যেতে পারে আদর্শ। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মৌলিক ইবাদতের পদ্ধতি, ইবাদতের মাধ্যমে অর্জিত রূহানিয়াত ও কল্যাণবিমুখ প্রতিযোগিতা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
ইসলাম যেখানে প্রদর্শনেচ্ছাকে জঘন্য কাজ বলে সাব্যস্ত করছে, সেখানে ইসলামি কোনো দলের মধ্যে প্রদর্শনেচ্ছা প্রবেশ গ্রহণীয় হতে পারে না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমরকে জেহাদ বিষয়ে অবহিত করতে গিয়ে প্রদর্শনেচ্ছাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি তুমি প্রদর্শনেচ্ছা ও সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করো তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে রিয়াকারী ও সম্পদ লোভী করে উপস্থিত করবেন।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৫১৯
প্রদর্শনেচ্ছা মুসলিম উম্মাহকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। উম্মাহর হাজারও বিভক্তি হওয়ার পেছনের কারণ ব্যক্তির প্রচার ও প্রসার হতে সৃষ্ট মতভেদ। প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াল থাবায় তৈরি হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হাজার দল ও উপদল। যথাসাধ্য উপায়ে এই রোগ হতে উম্মাহকে মুক্ত করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রদর্শনেচ্ছামুক্ত উম্মাহ গঠনের জন্য প্রয়োজন সাদামাটা জীবন যাপন ও ইবাদতে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি। দ্বীনের প্রয়োজনে বর্তমান সময়ে কিছু কাজের প্রচার গ্রহণীয় হলেও ব্যক্তি যেন এটাকে কোনোভাবেই বেশি গুরুত্ব না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। এক হাত দিয়ে দান করলে অন্য হাত যেন না বুঝতে পারে এই নীতি অবলম্বন করা উচিত।