সৌদি আরবের বুলেটপ্রুফ মসজিদ

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আর রাজি মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব, ছবি: সংগৃহীত

আর রাজি মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব, ছবি: সংগৃহীত

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল জাজিরা অঞ্চলে অবস্থিত আর রাজি মসজিদ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ মসজিদটি দেখতে ছুটে আসেন। আর রাজি মসজিদ শায়খ সোলায়মান বিন আবদুল আজিজ আল রাজি নির্মাণ করেন, এটা ২০০৪ সালে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন করেন রিয়াদ প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আলে সৌদ।

বুলেটপ্রুফ মসজিদ কেন?
আর রাজি মসজিদটি সুরক্ষার চাদরে ঘেরা। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই তাকে ‘বুলেটপ্রুফ মসজিদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিশেষভাবে সুরক্ষিত ও ব্যতিক্রমী স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত এ মসজিদ। নামাজের সময়গুলোতে মুসল্লিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। অত্যাধুনিক সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ মসজিদে।

বিজ্ঞাপন

মসজিদটি ১৩,২৬০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত। যার মোট বিল্ডিং এরিয়া ৪৩,৫৬৮ বর্গমিটার। মসজিদের নকশায় আছে আন্দালুসীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া। মসজিদের দুটি মিনার। প্রতিটির উচ্চতা ৫৫ মিটার। প্রধান গম্বুজটির ব্যাস ২৮.৮ মিটার। এটি ভূমি থেকে ৩৭ মিটার ওপরে অবস্থিত। মসজিদের কেন্দ্রীয় অভ্যন্তরীণ হলটির উচ্চতা ২৫ মিটার, যা কাচের ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত, ফলে প্রাকৃতিক আলো ভেতরে প্রবেশ করে। এ ছাদটিও কিন্তু বুলেটপ্রুফ।

মসজিদের বৈশিষ্ট্য
মসজিদটির বিস্তৃত এলাকা নানা ধরনের ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় এই প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক সেবা প্রদান করা হয়। নামাজের মূল স্থানটি ৩৬০০ বর্গমিটারজুড়ে বিস্তৃত। পুরুষদের জন্য নামাজের স্থান তিন তলা। যেখানে প্রায় ১৮ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। নারীদের জন্য দুই তলাবিশিষ্ট আলাদা নামাজের জায়গা আছে। যেখানে প্রায় আড়াই হাজার জন নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদ উদ্বোধন করছেন বাদশাহ সালমান, পাশে প্রতিষ্ঠাতা শায়খ সোলায়মান বিন আবদুল আজিজ আল রাজি

আর রাজি মসজিদের গ্রন্থাগারটি একটি গবেষণাগার হিসেবে পরিচিত। এখানে গবেষকরা ও শিক্ষার্থীরা গবেষণার কাজ করেন। এখানে বিভিন্ন ভাষার প্রায় ৬৭ হাজার বই আছে। ইসলামি ফিকাহ, সাহিত্য, প্রয়োগিক বিজ্ঞান, সংস্কৃতি বিষয়ক বই আছে এখানে। গ্রন্থাগারটি ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও ই-বুকসমৃদ্ধ। গ্রন্থ পাঠের আধুনিক ডিভাইসও রয়েছে এখানে। ছোট শিশুদের জন্যও একটি পৃথক সেকশন রয়েছে। যেখানে ছোটরা খেলাধুলা করে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। আনন্দ বিনোদন নিতে পারেন।

মসজিদের অন্যান্য সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে- গণমাধ্যম অফিস, সেবা প্রতিষ্ঠান, জরুরি সেবা প্রদানসহ আরও অনেক কিছু। এছাড়া মসজিদে একটি হল, বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য একটি অভ্যর্থনা কক্ষ। মৃতদের পরিবারের জন্য আলাদা একটি অভ্যর্থনা কক্ষ রয়েছে। মৃতদের জানাজা পড়ার আলাদা ব্যবস্থা। মৃতদের রাখার আলাদা ফ্রিজিং সেকশন।

মৃতদেহ গোসলের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত আধুনিক গোসলখানা। এখানে একসঙ্গে ১১টি মৃতদেহের কাফন পরানোর ব্যবস্থা রয়েছে। পুরুষ নারীদের আলাদা ব্যবস্থা। ছয়টি পুরুষের জন্য, পাঁচটি নারীদের জন্য। এছাড়াও দুর্ঘটনা বা পচনশীল দেহের জন্য একটি পৃথক গোসলখানারও ব্যবস্থা রয়েছে। আধুনিক সব ব্যবস্থাপনায় সুসজ্জিদ এ মসজিদ।

মসজিদে বড় ধরনের অনুষ্ঠান কার্যক্রম ও বিপুল পরিমাণে আগত মেহমানের সেবা প্রদানের জন্য বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে। এ পার্কিং এলাকা প্রায় ২১০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এতে প্রায় ৩৫০টি গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া মসজিদের চারপাশে আরও ৩৫০টি গাড়ির পার্কিং এরিয়া রয়েছে।

মসজিদের কার্যক্রম
মসজিদে কোরআন মুখস্থ, তেলাওয়াত ও তাজবিদ শিক্ষার জন্য প্রায় ৪০টি ক্লাস পরিচালিত হয়। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৩৭৮ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। প্রতিবছর ৫৬ জনের বেশি শিক্ষার্থী কোরআন মুখস্থ সম্পন্ন করেন। প্রায় ১১৭ জন শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট অর্জন করেন।

বিজ্ঞাপন
মসজিদের ভেতরের দৃশ্য

এ ছাড়া মসজিদে দারুল বায়ান নামে নারীদের জন্য একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। সব বয়সের নারীদের কোরআন তেলাওয়াত, তাজবিদ ও মুখস্থের শিক্ষা দেওয়া হয়। ইনস্টিটিউটটি প্রতি বছর প্রায় ২৩টি ক্লাস পরিচালনা করে। প্রায় ৩৯৮ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। প্রতিবছর প্রায় ৬৩ জন নারী শিক্ষার্থী কোরআন মুখস্থ সম্পন্ন করেন। প্রায় ১৪ জন নারী শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট অর্জন করে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
দাওয়াহ ও ইসলামিক শিক্ষার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, মসজিদে একটি বৈশ্বিক অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন কেরাতসহ কোরআন মাজিদ শিক্ষা প্রদান করে। প্রতিবছর প্রায় ১০২২ জন শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করেন।

মসজিদ পরিচালনা কর্তৃপক্ষের অধীনে একটি সমন্বিত ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের সব কেন্দ্রীয় ও পরিচালনা ইউনিট পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে কাজ করে। মসজিদের সাউন্ড সিস্টেম উন্নত এক্সোস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্যান্ডার্ডে পরিচালিত হয়। এতে একটি সমন্বিত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে।

নির্মাণ খরচ
এ ব্যতিক্রমী মসজিদটি মধ্যপ্রাচ্যের এক বিস্ময় স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মুসলিম পর্যটকদের ব্যাপক আগমন ঘটে এখানে। প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার খরচে নির্মিত হয় এ মসজিদ। কাঁচ, লোহার সংমিশ্রণ ও নিরাপত্তার বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার মাধ্যমে একে বুলেটপ্রুফ করে তুলেছে। মসজিদটির নির্মাণে ব্যয়বহুল উপাদান ব্যবহার ও জটিল স্থাপত্য পরিকল্পনা থাকায় এতে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে। মুসল্লিদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মসজিদটি বুলেটপ্রুফ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মসজিদের ইমাম-খতিব
মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায়ে সক্ষম। শুক্রবার ও ঈদের সময়ে এখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্রিত হয়। মসজিদের ইমাম হিসেবে রয়েছেন শায়খ আহমাদ আল কাহতানি। স্থানীয়দের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় শায়খ কাহতানি ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে প্রভাবশালী বক্তা। তার খুতবা শোনার জন্য মুসল্লিরা অনেক দূর থেকে এখানে আসেন।

মসজিদের ভেতরের দৃশ্য

মসজিদের খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শায়খ আবদুল করিম আল হাশেমি। তার খুতবায় সমাজের নৈতিকতা, আদর্শ, পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। মুসল্লিরা তার বয়ান শোনার জন্য আগ্রহী থাকেন। খতিব হিসেবে প্রায় ৮ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।

স্থাপত্য ও প্রকৌশলী
মসজিদের স্থপতি ছিলেন খ্যাতিমান প্রকৌশলী মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক স্থাপত্যের একজন সেরা প্রতিভা। নিরাপত্তার দিকটি প্রাধান্য দিয়ে এমন একটি নকশা তৈরি করেছেন, যা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত। মসজিদের দেয়ালে ব্যবহৃত হয়েছে উচ্চমানের বুলেটপ্রুফ গ্লাস ও স্থাপত্যে মার্জিত ইসলামিক শিল্পশৈলীর নিদর্শন রয়েছে।

এই বুলেটপ্রুফ মসজিদ শুধু নিরাপত্তার চিহ্ন নয়, এটি স্থানীয় মুসলিম সমাজের প্রাণের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মসজিদটি শুধু স্থাপত্যের দিক থেকে অনন্য- তা নয়, বরং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি প্রশান্তিময় স্থান, যেখানে তারা নির্ভয়ে ইবাদত করতে পারেন।