হজ স্থগিত ও কাবা বন্ধ রাখা হয় যেসব বছর
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো হজ । ফরজ ইবাদতের মধ্যে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিসেও হজকে সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে। তবে হজের এ গুরুত্ব বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে বেশি সম্পর্কযুক্ত হজের তাৎপর্যের সঙ্গে। যেমন হজযাত্রায় ইহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে রওয়ানা হওয়াকে কাফন পরে আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আখেরাতের পথে রওয়ানার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয়, সবকিছু ছেড়ে আখেরাতের সফরে পাথেয় সঙ্গে নেয়ার প্রয়োজনয়ীতা। হজের আনুষ্ঠানিকতা পালনের কষ্ট মনে করায় মুমিনের জীবন বল্গাহীন নয়, মুমিনের জীবন আল্লাহর রশিতে বাঁধা। তাইতো সে লাব্বাইক... বলে সেদিকে যেতে প্রস্তুত।
পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবাঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাকে হজ বলে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ- পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। বেহেশত ছাড়া আর কোনো কিছুই এর প্রতিদান হতে পারে না।’
হজ আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত। উম্মতে মুহাম্মদির জন্য হজ একটা দুর্লভ প্রাপ্তি। প্রতি বছর ৮ থেকে ১২ জিলহজ হজ পালনের নিমিত্তে মক্কার চারপাশ মুখরিত হয়, লাখো মুসলমানের লাব্বাইক ধ্বনিতে।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সৌদি আরবেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় এবারের হজ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবার বাতিল হতে পারে হজ। ইতিহাসে হজ বাতিলের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে আধুনিক ইতিহাসে এটা বিরল।
মার্চ মাসের শুরুতেই কাবা চত্বর করোনাভাইরাসের জীবাণুমুক্ত করার জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানুষবিহীন কাবার ছবি দেখে অনেকেই তাদের কষ্টের কথা নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাতে ইসলাম শেষ হয়ে গেল, কেয়ামত এসে পড়ল বলে হা-হুতাশ করার কিছু নেই। হজ ও কাবা বন্ধ হওয়ার ঘটনা আগেও অনেকবার ঘটেছে।
সর্বশেষ ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই। একদল ইরানি হাজি কাবা চত্বরে ইসরায়েল-আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ করলে সৌদি পুলিশ আর ন্যাশনাল গার্ড তাতে বাধা দেয়। এরপর সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তখন কাবার তাওয়াফ বন্ধ করা হয়। এর আগে ১৯৭৯ (২০ নভেম্বর) সালে জুহাইমান আল ওতাইবি তার এক শিষ্যকে ইমাম মাহদি দাবি করে কাবা ঘর দখল করে নেয়। সে সময় প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কাবা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ ছিল। কোনো তাওয়াফ অনুষ্ঠিত হয়নি।
প্রথম মক্কা অবরোধ (৬৮৩ সাল) ও দ্বিতীয় মক্কা অবরোধে (৬৯২ সাল) কাবা ঘর একবার আগুনে আরেকবার পাথরের আঘাতে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সম্পূর্ণ নতুন করে কাবাঘর নির্মাণ করতে হয়েছিল। তবে প্রথমবার হজ বাতিল হয়েছিল ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। আব্বাসীয়দের সময় ইসমাঈল বিন ইউসুফের মক্কা আক্রমণের কারণে।
এরপর হজ বন্ধ হয়েছিল ৯৩০ সালে। কট্টর শিয়া গ্রুপ কারমাতিদের আক্রমণে সে বছর ৩০ হাজার হাজি শহীদ হয়। তারা হাজিদের হত্যা করে মরদেহ জমজম কূপে ফেলে দেয়, ফিরে যাওয়ার সময় হাজরে আসওয়াদ বাহরাইনে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে হাজরে আসওয়াদ পুনরুদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় এক দশক হজ বন্ধ ছিল।
ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে বলা হয়েছে, ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় একটি রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ সময় মক্কায় হজযাত্রীদের ব্যবহৃত উটগুলো পানির অভাবে মারা যায়। সেবারও হজ বন্ধ ছিল।
৯৮৩ থেকে ৯৯০ সাল পর্যন্ত হজ বাতিল হয়েছিল রাজনীতির কারণে। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আব্বাসীয় খিলাফত এবং মিসরভিত্তিক ফাতেমীয় খিলাফতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে সেবার টানা ৮ বছর হজ বন্ধ ছিল।
১০০০ খ্রিস্টাব্দে ব্যয় মেটাতে অক্ষম হওয়ায় প্রায় ২৯ বছর মিসর, ইরাক, মধ্য এশিয়া ও উত্তর আরব অঞ্চলের কোনো হজযাত্রী হজপালনে আসেননি। ১০৩০ সালে কয়েকজন ইরাকি হজযাত্রী হজপালনের জন্য মক্কায় আসেন। অর্থনৈতিক কারণের তুলনায় এ সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ হজপালনে আসেননি।
একইভাবে যুদ্ধের কারণে মুসলিম বিশ্বজুড়ে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে কেউ ১০৯৯ সালে হজ করেননি।
কাবায় তাওয়াফ বন্ধ হয়েছিল ১২৫৮ সালে। সেবার বাগদাদ অবরোধ করে হালাকু খান। অবরোধ বেশ লম্বা ছিল। ভয়ে মানুষ বের হয়নি। সেবার উমরা ও হজ বন্ধ করা হয়। হালাকু খান শুধু বাগদাদে দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল।
১৬২৯ সালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয় মক্কায়। তখন কাবার দেয়াল ধসে যায়, বন্ধ হয় তাওয়াফ। বন্যা শেষে গ্রানাইট পাথরে নতুন করে কাবা বানানো হয়। উসমানি সম্রাট চতুর্থ মুরাদের আমলে তখন কাবা ঘর সুন্দর করে আবার বানানো হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেই একই মূল গঠন আছে।
শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, মহামারির কারণেও হজ বাতিল হয়েছিল। প্রথমে ১৮১৪ সালে হেজাজ প্রদেশে প্লেগের কারণে ৮ হাজার মানুষ মারা যাওয়ায় হজ বাতিল করা হয়। এরপর ১৮৩১ সালে ভারত থেকে যাওয়া হজযাত্রীদের মাধ্যমে মক্কায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং চারভাগের তিনভাগ হাজি মৃত্যুবরণ করে। ফলে সে বছর হজ বাতিল করা হয়। এছাড়া ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে প্লেগ এবং কলেরার কারণে তিন বারে মোট ৭ বছর হজ বন্ধ ছিল। ইতিহাসে এটাও দেখা গেছে, রাজনৈতিক সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সময় বর্হিবিশ্বের হাজিরা কিংবা নির্দিষ্ট দেশের হাজিরা হজপালনে আসেননি। রাজনৈতিক কারণে সর্বশেষ ২০১৬ সালে ইরান তাদের কোনো নাগরিককে হজপালনের জন্য সৌদি আরব পাঠায়নি।
এবারও যদি হজ বন্ধ হয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, অতীতেও হজ বাতিল হয়েছিল। আর ইসলাম অবাস্তব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় না। সুতরাং মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলে বিজ্ঞ মুফতিরা হজ বাতিলের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
মক্কা ও মদিনা মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র দুই শহর। হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় মক্কায়। আর মদিনায় নবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক অবস্থিত। করোনার কারণে শহর দুটি এক মাসের বেশি সময় ধরে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির সময়ও এই দুই শহর বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
অবশ্য সৌদি আরব এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বিশ্ববাসীকে হজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে হজ মৌসুমের এখনও অনেক দেরি। আশার কথা হচ্ছে, চীন, ইতালি ও স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা চূড়ান্তে পৌঁছানোর পর এখন তা নিচের দিকে নেমে এসেছে। তাই আশা করা যায়, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ যেসব দেশে নতুন রোগীর সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী; তাদের ক্ষেত্রেও আগামী দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে কমতে শুরু করবে। এর মধ্যে সৌদি আরবেও ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো হজ পুরোপুরি বাতিল না করে, শুধুমাত্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে হজযাত্রীদের আগমন আপাতত নিষিদ্ধ করা হতে পারে।