করোনা পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রতি দায়িত্ব
'স্কুল আজ বন্ধ বহুদিন
সঙ্গে বন্ধ টিউশনি।
আছি গৃহবন্দি
এ অবস্থা কার ভালো লাগে শুনি?
কতদিন দেখিনি স্কুলের বন্ধু আছে যারা,
কি জানি এ অবস্থায় কেমন আছে তারা ?
একঘেয়েমি লাগছে
নেই বন্ধু নেই পাড়া ঘোরা অদ্য
কি করব উপায় তো নেই ?
তাই আছি হয়ে বাধ্য।'
কথাগুলো শুধুমাত্র একজন শিশুর কথা নয়, হাজার হাজার শিশুর মনের আকুতি।
বর্তমান সময়ে বিশ্ব এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বজুড়ে চলছে বিপর্যয়। হারিয়ে গেছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। কলকারখানা বন্ধ, ট্রেন-বাস সহ যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। মানুষ আজ গৃহবন্দী। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ আর বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না।
এরই মধ্যে আবার অনলাইনে বা ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনা চলছে। মানুষ গৃহবন্দী থাকতে থাকতে হতাশ হয়ে পড়েছে। কেননা গতিশীলতাই জীবন। কিন্তু আজ জীবন হয়েছে ছন্দহীন। এই দুঃসহ পরিবেশে বাড়ির ছোট্ট ছোট্ট ফুলের মত শিশুরা কেমন আছে?
তাদের স্কুল বন্ধ, খেলার মাঠে জমায়েত হওয়া বন্ধ, টিউশনি, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও দেখা নেই। তার ওপর চেপেছে অনলাইন ক্লাসের ভারি বোঝা। সত্যিই তো তারা আজ কেমন আছে? তাদের মনের অবস্থা কেমন?
সর্বস্তরের মানুষই আজ যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে শিশুরাও অসহায়। শিশুরা আজ তার মাকে প্রশ্ন করছে, মা কবে করোনা শেষ হবে? স্কুল কবে খুলবে? কবে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যাব?
কিন্তু তার মায়ের দিক থেকে এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। সত্যিই উত্তর কারোই জানা নেই।
ইউনিসেফ এবং WHO-এর মতে দীর্ঘকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপ পড়ছে ,তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকার ফলে তারা অনেকটা নিঃসঙ্গ বোধ করছে।
অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব, অল্পতে রেগে যাওয়া, চুপচাপ হয়ে যাওয়া, বিরক্তিভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তদুপরি, দীর্ঘ সময় মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটারে অনলাইন ক্লাস করা বা অনলাইনে গেম খেলা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
আর বন্ধের মধ্যে নিত্যকার স্বাভাবিক রুটিন কাজকর্মে অলসতা, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, এলোমেলো জীবন যাপনের ফলে তার স্থূলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘরবন্দী জীবনযাপন তার পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
দরিদ্র পরিবারের শিশুদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেক অভিভাবকেরই কাজ নেই। সেসব পরিবারের শিশুদের খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবকিছুর ওপর গভীর প্রভাব পড়েছে।
আসলে বর্তমান জটিল ও কঠিন পরিস্থিতিতে বড়দেরই যেখানে শোচনীয় অবস্থা, সেখানে শিশুদের অবস্থা আরো খারাপ। তাই মেজাজ খিটখিটে হওয়া, চুপচাপ হয়ে যাওয়া বর্তমানে আর অস্বাভাবিক নয়।
বর্তমান পরিস্থিতির কারণে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সে একাকীত্বে ভুগছে। কিন্তু দীর্ঘদিন কাজ না থাকার ফলে অভিভাবকদেরও কিছু করার নেই। শিশু অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। হয়তো পরবর্তীকালে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ভাগ্যলিখন আরো কঠিন হতে চলেছে ।
তাই এখন প্রশ্ন হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কি করনীয়? শিশুদের অভিভাবকদের দায়িত্ব হবে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা।শিশুদের জীবনে যে চক্রাকার পর্ব অর্থাৎ স্কুল থেকে টিউশন, টিউশন থেকে খাওয়া, খেলা ঘুমানোর নিয়ম ছিল, সে তো আজ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
এ অবস্থায় অভিভাবকদের উচিত তাদের সামনে সদর্থক কথাবার্তা বলা, সদর্থক আচরন করা । তাদেরকে নাচ-গান, ছবি আঁকা, বাড়িতে বাগান তৈরির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা। আর কথায় বলে না, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।
কাজেই তাদেরকে যথেষ্ট সময় দেওয়া, তাদের সঙ্গে তাদের মতো করে খেলা, গল্প বলা, সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। তাতে তার মন ভালো থাকবে । মনের ওপরে চাপ কম পড়বে ।
শিশুদেরকে শেখাতে হবে যে জীবনে ভালো সময় যেমন আছে তেমনি খারাপ সময় আসে ।এতে ভেঙে পড়লে চলবে না । প্রয়োজনে বয়স ও শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী বাড়িতে হাতে হাতে কাজ করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
আর পিতা-মাতার কলহ যেন তার সম্মুখে না আসে। তাতে তার ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে। সে যদি কোন ভুল কাজ করে তাকে বকাঝকা নয়, বরং তাকে বোঝাতে হবে কেন তার কাজটি ভুল।
এমনিতে শিশুমনে বন্ধু, স্কুল, খেলার মাঠ ছেড়ে থাকায় এক অজানা আশঙ্কার কালোমেঘ জমে আছে । তাই এসময় বকাঝকা করলে ফলাফল হিতে বিপরীত হবে । তাই শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গ দিতে হবে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিশুদের আবার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদেরই।
লেখক: কবি, সহকারী অধ্যাপক, (ইতিহাস), সরোজিনী নাইডু কলেজ, কলকাতা।