আজ মন ভালো নেই!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সামুদ্রিক ঝড় 'তিতলি'র প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তৃত  অঞ্চল বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। মূল আঘাত দক্ষিণ-পশ্চিমের অন্ধ্র-উড়িষ্যার উপর দিয়ে বয়ে গেলেও দক্ষিণ-পূর্বের বাংলাদেশ-পশ্চিম বঙ্গও বর্ষণ কবলিত। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সমুদ্রতট ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বস্ত হয়েছে। কলকাতাও হয়েছে বর্ষণসিক্ত।

যে 'তিতলি' ঝড়ের প্রভাবে কালরাত থেকে বৃষ্টি উপদ্রুত হয়েছে মানুষ, সে 'তিতলি' নামটি পাওয়া যায় উর্দু ও হিন্দি ভাষায়, যার অর্থ প্রজাপতি। ঝড় না হলেও বৃষ্টি হচ্ছে প্রজাপতি নৃত্যছন্দে। আর তখনই দুর্যোগের পাশাপাশি প্রেমকাতরতা আর মন খারাপের মেঘ জমে মানুষের একান্ত মনের আকাশে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞানিরা বৃষ্টির সঙ্গে প্রেমার্ত হৃদয়ের সম্পর্ক পেয়েছেন। আর পেয়েছেন মন খারাপের কার্যকারণ। আজকাল অবশ্য কেবল বৃষ্টির দিনগুলোতেই নয়, প্রায়-সব সময়ই মানুষের 'মন ভালো নেই' সমস্যা চলছে। আর্থ-সামাজিক নানা সমস্যায় শরীরের মতো মনও আকছার বিষণ্ন হচ্ছে নানা বয়সী মানুষের।

মন ভালো না থাকাটা একদা ছিল আকস্মিক। প্রেমে ব্যর্থ বা জীবনের অসফলতার জন্য ‘মন ভালো নেই’ বলে কেউ কেউ কিছুদিন চুপচাপ থাকতেন। আজকাল ‘মন ভালো নেই’ একটি সংস্ক্রামক ব্যধি হয়ে গেছে। বিশেষত শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ‘ভাল্লাগে না’ প্রবণতা ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। খারাপ মন নিয়ে নিজের ও পারিপার্শ্বিক জীবন বিষিয়ে তুলছে তারা। কখনো মাদক বা আত্মঘাতী প্রবণতায় জড়াচ্ছে। কেউ কেউ মারমুখী ও ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে হতাশ জীবনের পথে চলে যাওয়া প্রজন্মের খোঁজ অনেক সময় বাবা-মা রাখতে পারেন না নানা ব্যস্থতায়। চরম একাকীত্ব ও হতাশায় নিজের সন্তানের মনের অতলে যে গভীর কালো জগত তৈরি হয়েছে, সে খেয়ালও অনেক অভিভাবক রাখেন না। সন্তানটি (ছেলে বা মেয়ে) নীল জগতের উদভ্রান্ত সীমানায় হারিয়ে যেতে থাকলেই টনক নড়ে পিতা-মাতার। ততক্ষণে হয়ত অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে!

বিষয়টি একদিকে যেমন সামাজিক, পারিবারিক সমস্যা। অন্য দিক থেকে স্বাস্থ্যগত সমস্যাও বটে। কারণ, স্বাস্থ্য বলতে বোঝানো হয়, শরীরিক ও মানসিক সুস্থতা, উভয়টিকেই। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে মানুষকে তার চারপাশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। এই উভয় প্রকার পরিবেশ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের চারপাশে সুপ্রভাবের চেয়ে কুপ্রভাবই বেশি, যার নেতিবাচক ফলাফল কিশোর-তরুণদের জীবনে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়।

শুধু প্লট-ভর্তি সুস্বাদু ও উচ্চমানের খাদ্য খাওয়া নয়, স্বাস্থ্য সচেতনতা হলো কিছু অভ্যাসের ও আচরণের বিষয় ও বিধি, যার দ্বারা আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারি। সুস্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই সুস্থ্যতা অপরিহায। অনেকেই জীবনযাপন প্রণালীতে শারীরিক ও মানসিক জীবনের ভারসাম্য এবং উভয় ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দিতে পারেন না। আর তখনই তৈরি হয় নানা সমস্যা ও সঙ্কট।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, মাত্র দুদিন আগে ১০ অক্টোবর ছিল পৃথিবীর সকলের মানসিক স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতার দিন । এটি ১৯৯২ সালে প্রথমবার পালন করা হয়েছিল । কিছু দেশে একে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসাবে পালন করা হয়। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয় সকলের জন্য সুস্থ্য মন ও সুস্থ্য শরীরের জন্য।

উনিশ শতকের আগে মন সম্পর্কীয় সকল অধ্যয়ন দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, স্বাস্থ্য বা চিকিৎসার বিষয়ে পরিণত হয় নি। দার্শনিকগণ মানসিক আচার-আচরণ বা ক্রিয়া-কলাপ সম্পর্কে কেবল অনুমান করেছিলেন। মন সম্পর্কে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা করেন। তিনি মনকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে গণ্য করেন। তারপর মন আর শরীর দিয়ে বিজ্ঞান হাজার বছর ধরেই চর্চা ও গবেষণা করেই চলেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম আধুনিক যুগে স্নায়ুবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে মনোবিজ্ঞানেরও নববিকাশ ঘটে ও আধুনিক বিজ্ঞানের এক অন্যতম শাখা হিসাবে মনোবিজ্ঞানের কার্যক্রর্ম আরম্ভ হয়।

স্নায়ুবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের মধ্যেই যে মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তি নিহিত হয়ে আছে, সেই কথা সর্বপ্রথম বলেন জার্মান শরীর বিজ্ঞানী জোহানেস পিটার মুলার। অবশ্য মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারটি করেছিলেন আরেকজন জার্মান বিজ্ঞানী হারমেন ভন হেল্মল্টজ্। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী টমাস ইয়ঙের প্রস্তাবিত রং সংক্রান্ত নীতি নিয়ে গবেষণা করে তিনি ইয়ং-হেল্মল্টজ্ সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সূত্র দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, তিনটে বিভিন্ন রঙের (সবুজ, নীল ও লাল) অনুভূতির সৃষ্টি হয় মানুষের চোখের রেটিনার সাথে সংযুক্ত তিন ধরণের স্নায়ুর কর্ম-তৎপরতার ফলে।

এরপর পরবর্তী আধুনিক মনোবিজ্ঞান একের পর এক গবেষণায় আমাদের মন সম্পর্কীয় রহস্য উদঘাটন করে। এখনও রহস্যময় মন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন মনোবিজ্ঞানীরা এবং মনের ভালো ও খারাপ অবস্থার দিক নিয়ে গবেষণা ও চিকিৎসা চালাচ্ছেন।

কিন্তু চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতা-পরিবেশ থেকে সন্তানদের প্রতি মনোযোগ ও লক্ষ্য রাখার কাজটিও গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে, এ কথাটি সব বিশেষজ্ঞই গুরুত্বের সাথে বার বার উল্লেখ করেছেন। আপনার ছেলে বা মেয়ে কোথায় যায়, কি করে, সেটা আগে-ভাগে জেনে সতর্ক হতে না পারলে বিপদই নেমে আসবে। খারাপ পরিবেশ না হটিয়ে উন্নত চিকিৎসা কোনও কাজেই আসবে না, এটাই হলে মূল কথা।

সাম্প্রতিক সময়ে এই বাংলাদেশেই এমন বহু মানসিক অস্থিরতা ও অপরাধের খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা বেদনাদায়ক। এই বিপদ ও বেদনা রোধের পূর্ব-প্রস্তুতি স্বরূপ শারীরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে তীক্ষ্ণ নজর দেওয়া এবং খারাপ পরিবেশ ও পরিস্থিতি প্রতিরোধ করার দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার দরকার আছে। নইলে সমস্যাটি সমূলে উৎপাটন অসম্ভব।

প্রসঙ্গত বলা যায়, মানুষের মন খারাপের অভিব্যক্তি কবিতাতেও ছাপ ফেলে। কবি মহাদেব সাহার পেশাগত পরিচয় ছিল সাংবাদিক। একদার অপ্রতিদ্বন্দ্বি দৈনিক ইত্তেফাক-এর তিনি ছিলেন সহকারী সম্পাদক। রোমান্টিক-প্রেমের কবিতায় সিদ্ধহস্ত এই কবি একবার রচনা করেছিলেন সুন্দর কিছু পংক্তি: ‘বিষাদ ছুঁয়েছে আজ/ মন ভালো নেই/ মন ভালো নেই/ ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা/সারাদিন ডাকি সাড়া নেই...।

বাংলা সাহিত্যের আরেক জনপ্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়াও ছিলেন সাংবাদিক। তারও চমৎকার কিছু লাইন আছে: ‘মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই/কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই/চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি…।’

কবিতা ও সাহিত্যের এমন রোমান্টিক ভাবালুতা যদি বাস্তব জীবনে চলে আসে, আপনার বা আমার ঘরের ভেতরের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তখন কিন্তু চরম বিপদ! এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তখন প্রাণান্তকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে।

বৃষ্টি বা মেঘলা দিনের খানিক মন খারাপ যদি সর্বক্ষণ আক্রান্ত করে, আপনাকে বা আপনার পরিবারের কোনও সদস্যকে, তখন সজাগ ও সতর্ক হোন। মানসিক স্বাস্থ্য দিবস তথা ১০ অক্টোবরই শুধু নয়, শরীর ও মনকে ভালো রাখতে খাদ্য, পুষ্টি, পরিবেশ, ব্যায়াম, বিশ্রাম দিয়ে এবং প্রকৃতি ও সুন্দরের দিকে ধাবিত হয়ে বছরের প্রতিটি দিনকেই ভরিয়ে তুলতে হবে ভালো লাগার অনিন্দ্য উপকূলে। জরা, ব্যাধি, কষ্টের সমীকরণের মধ্যেও সুন্দর আর আশাবাদী করতে হবে আমাদের যাপিত জীবনের এইসব দিনরাত্রিগুলোকে।