নিজেকে জানুন

  • ড. হাসিন চেরী, সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, ইংল্যান্ড
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

নো দাইসেলফ সম্পর্কে অনেক মনীষী অনেক কথাই বলেছেন। পিথাগোরাস বলেছেন "যখন তুমি তোমাকে জানবে তখন তুমি পৃথিবী এবং প্রভুকে জানতে পারবে" সক্রেটিস বলেছেন- "আত্মজ্ঞানের শুরুটা হলো নিজেকে জানা"

বিখ্যাত ইংলিশ পয়েট আলেকজেন্ডার পোপ এর একটি কবিতার শুরুর প্রথম দুটি লাইনে তিনি বলেছেন-

বিজ্ঞাপন

“Know then thyself, Presume not God to scan,
The proper study of mankind is man.

মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং আচার ব্যবহারের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, সেসব ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি কার্য্যক্ষম যারা নিজের চরিত্রের শক্তিশালী এবং দুর্বল দিকগুলো সম্পর্কে প্রত্যক্ষ্য ধারণা রাখেন। কারণ নিজের চরিত্রের এই দিকগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণাই কেবলমাত্র একজন ব্যক্তিকে তার আশেপাশের পরিবেশের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলবার মতো সঠিক কৌশল নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। ব্যক্তি চরিত্রের একটা অংশ আসে তার জিনগত বৈশিষ্ট্য থেকে এবং বাকি অংশটুকু আসে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে। এই দুই উপাদান ব্যক্তির চরিত্র তৈরি করে যার প্রকাশ পায় তার দৈনন্দিন ব্যবহারে।

মানব চরিত্রের এই বিশ্লেষণ ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন পরিস্থিতে কোনো ব্যক্তি কিরূপ আচরণ করছেন কিংবা করবেন তার পেছনের কারণগুলো বুঝতে পারলে সেই ব্যক্তিকে মোকাবিলা করাটা অনেকটাই সহজ হয় এবং এতে করে অনেক অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়। একারণেই বিশ্বের বড়ো বড়ো কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে ৪ টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ব্যক্তির চারিত্রিক এই বিশ্লেষণ করা হয়, যার ফলাফলের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় যে কোনো ব্যক্তি কিসের ভিত্তিতে তার আচরণগুলো করে থাকেন।

মানব চরিত্রের বিশ্লেষণের জন্যে ব্যবহৃত এই পরীক্ষাটির নাম হলো DISC ASSESSMENT. এটি বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত টুল যার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণগত মূল্যায়ন করা হয় এবং এটি প্রতি বছর বিশ্বের Fortune 500 কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্তত ৭৫% এর লক্ষাধিক কর্মীর জন্যে ব্যবহার করা হয় বলে অনুমান করা হয়।

DISC হল একটি খুব সহজ কিন্তু শক্তিশালী চার-চতুর্ভুজ কাঠামো যা ব্যক্তির আচরণের সাধারণ প্রক্রিয়াগুলিকে প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয় । এই ৪ টি মানদণ্ড হলো :

১. Dominance বা আধিপত্য: এটা থেকে নির্ণয় করা যায় যে ওই ব্যক্তি যেকোনো সমস্যা কিংবা চ্যালেঞ্জ এর কিভাবে মোকাবেলা করবেন।

বিজ্ঞাপন

২. Influence বা প্রভাব : এটা থেকে নির্ণয় করা যায় যে উক্ত ব্যক্তি তার কোনো মতামতের স্বপক্ষে অন্যকে কিভাবে প্রভাবিত করেন।

৩. Steadiness বা স্থিরতা: যার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় যে উক্ত ব্যক্তি তার আশেপাশের পরিবেশের গতির সাথে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারেন।

৪. Compliance বা সম্মতি: যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় যে উক্ত ব্যক্তি অন্য কারো দ্বারা নির্ধারিত নিয়ম কানুনের প্রতি কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তির চরিত্রেই এই চার প্রকার মানদণ্ডের উপস্থিতি রয়েছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে। এই DISC ASSESSMENT যেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কর্পোরেট কোম্পানি গুলোর উচ্চ দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়, Training and Development এর ক্ষেত্রে যেমন: Leadership Development, Communication Effectiveness, Team Effectiveness, Sales Development, Customer Service Training ইত্যাদি । ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানেও এই ASSESSMENT TECHNIC এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে যেমন Marriage Counselling, Career Planning, Family Relationships ইত্যাদি ক্ষেত্রে। কারণ এই ASSESSMENT ব্যক্তিকে নিজের এবং আশেপাশের মানুষকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে, যার ফলশ্রুতিতে সেই ব্যক্তি অপরের সাথে আরো ভালোভাবে communicate করতে পারে, অন্যকে ভালোভাবে বুঝে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এখন দেখি এই পদ্ধতিকে DISC বলা হয় কেন। এই পদ্ধতিটা ব্যক্তির পার্সোনালিটিকে ৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়:

১. D টাইপ (Dominate), the Boss, যাদের কোড রং লাল : এই গ্রুপের ব্যক্তিরা মানসিক ভাবে খুব শক্ত হয়, এদের লক্ষ্য এবং সংকল্প থাকে দৃঢ়, এরা প্রচন্ড উচ্চাকাঙ্খী, শক্তিশালী, নিয়ন্ত্রণকারী এবং কিছুটা আক্রমণাত্মক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন। এরকম ব্যক্তিত্বের মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একাই নিতে পছন্দ করেন এবং এক্ষেত্রে প্রধানতঃ তাদের একক মতামতকেই তিনি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এরকম শক্তিশালী এবং প্রতিযোগিতামূলক ব্যক্তিত্বের অধিকারী বলে এরকম মানুষেরা কর্মক্ষেত্রে সফল এবং অগ্রগামী থাকেন। কিন্তু এরকম ব্যাক্তিত্বের মানুষদের দুর্বল দিক হলো তারা অন্য মানুষদের কথা তেমন একটা ভাবেন না, অন্যের আবেগ অনুভূতির প্রতি তারা যত্নশীল নন কারণ তাদের মানসিকতা হলো যেকোনো উপায়ে দ্রুতগতিতে যেকোনো কাজ আদায় করা। D টাইপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সফল মানুষের উদাহরণ হলো এঞ্জেলিনা জোলি অথবা বিশ্ববিখ্যাত বাস্কেট বল প্লেয়ার মাইকেল জর্ডান।
D টাইপের ব্যক্তিত্বদের সাথে কাজ করার সময়, সমস্যা, নেতিবাচক পয়েন্ট এবং ছোট বিবরণের উপর জোর না দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কেনোনা তারা যেকোনো বিষয়ে বহুদূর ভাবেন বিধায় এক্ষেত্রে তাদের আপনাকে অনুপুযুক্ত বলে মনে হতে পারে। এই ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের সাথে কথা বলার সময় আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলার চেষ্টা করুন এবং নিজেকে পুনরাবৃত্তি করা এড়িয়ে চলুন।

২. I টাইপ (Influential ), the Communicator, যাদের কোড রং হলুদ : এই গ্রুপের ব্যক্তিরা অন্যের ওপর তাদের সহজাত communication skill এর কারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। এরা চুম্বকের মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন বিধায় অত্যন্ত উষ্ণ, বিস্বস্ত এবং বন্ধুত্বপরায়ণ হয়ে থাকেন। এই ব্যাক্তিত্বের মানুষেরা উৎসাহী এবং আশাবাদী ধরণের হবার কারণে অন্যকে সহজেই প্ররোচিত করবার ক্ষমতা রাখেন। এই ব্যক্তিত্বের মানুষেরা অনেক কথা বলতে ভালোবাসেন এবং অন্যের সাথে সব কিছু শেয়ার করে নিত্য নতুন মানুষের সাথে কানেক্শন তৈরির মাধ্যমে তারা আনন্দ লাভ করেন। তবে তাদের ব্যক্তিত্বের দুর্বল দিক হলো, এধরণের মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, এবং যেহেতু তারা নিত্য নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগ তৈরী করতে থাকেন তারা সবসময় অন্যকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হন না। I টাইপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী সফল মানুষের উদাহরণ হলো বিখ্যাত অভিনেতা Will Smith.

I টাইপ ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করার সময়, সম্পর্ক তৈরি করা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া অপরিহার্য। একটি অনুকূল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের পরিবেশে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সবচেয়ে ফলপ্রসূ। তাদের ধারণাগুলিকে মৌখিকভাবে প্রকাশ করার জন্য তাদের প্রচুর সুযোগ দিন, কারণ তাদের সাধারণত খুব সৃজনশীল চিন্তা থাকে এবং খুব সহজেই যেকোনো সমস্যার সমাধানে এরা পারদর্শী হয়ে থাকেন।

৩. S টাইপ (Steady), the Turtle, যাদের কোড রং সবুজ: এধরণের ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষেরা অত্যন্ত শান্ত এবং ধীরস্থির ধরণের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন, যেকারণে এদের Turtle এর সাথে তুলনা করা হয়। এদের ধৈর্য্য শক্তি থাকে অসীম এবং এরা এদের পছন্দের বিষয়ে নিয়মিত ভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ কঠিন শ্রম দিয়ে যেতে পারেন বিধায় সাফল্য লাভ করেন। এধরণের মানুষেরা নিজ ইচ্ছায়ই তাদের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত যত্নশীল হয়ে থাকেন বিধায় এরা অন্যের জন্যে পজিটিভ শক্তি হিসেবে কাজ করেন।এদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি হলো এধরণের মানুষেরা হঠাৎ করে বদলে যান না, তাই এদের ওপর দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্ভর করা যায়। এধরণের ব্যক্তিত্বের মানুষেরাও অন্যদের সাথে মিশতে পছন্দ করেন, তবে তাদের মেশার ধরণটা I টাইপের মানুষের চেয়ে কিছুটা আলাদা। যেখানে I টাইপের মানুষদের অগুনিত বন্ধু থাকে সেখানে S টাইপের মানুষদের একদম হাতে গোনা খুব কাছের আপন কিছু বন্ধু থাকে যাদের সাথে তারা অত্যন্ত আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন আজীবন। এধরণের ব্যক্তিত্বের মানুষের দুর্বল দিক হলো যে তারা খুব সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারেন না এবং তাদের আশেপাশে কোনো কিছু হঠাৎ বদলে গেলে তারা সেই পরিবর্তনে সহজে অভ্যস্ত হতে পারেন না। S টাইপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিখ্যাত মানুষের উদাহরণ হলো Julia Roberts এবং Tom Hanks.

S টাইপ ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করার সময় খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, তার সামনে আপনি যেনো নিজের মতামতকে খুব বেশি জোর দিয়ে প্রকাশ না করেন, কেননা এদের সামনে নিজেকে জোর দিয়ে প্রকাশ করবার পূর্বে তাদের আস্থা অর্জন করাটা খুবই জরুরি।
এই ব্যক্তিত্বের মানুষদের হঠাৎ করেই কোনো বড় সিদ্ধান্তের জন্য জিজ্ঞাসা করবেন না।যেকোনো ব্যাপারে এদের দায়িত্ব দেবার পূর্বে নির্দেশিকা যতটা সম্ভব স্পষ্ট করুন এবং যেকোনো বিষয়ে এই ব্যক্তিত্বের মানুষদের সৎ প্রতিক্রিয়া পেতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করুন।

৪. C টাইপ (Cautious) or the Smart one, যাদের কোড রং নীল: এধরণের ব্যক্তিত্বের মানুষরা সাধারণতঃ সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী, বিচক্ষণ ও যৌক্তিক হয়ে থাকেন। এদের জীবন ধারণের মধ্যে সাবধানতা, নিয়মানুবর্তিতা, পদ্ধতিগত নিয়ম কানুন মেনে চলা অত্যন্ত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এধরণের ব্যক্তিত্বের অধিকারীরা সব কিছু খুব সূক্ষ্ণ ভাবে বিস্তারিত পর্যালোচনা করতে পারেন বিধায় যেসব কর্মকান্ডে খুব গভীর মনোযোগ এবং বিস্তারিত লক্ষ্য করবার প্রয়োজন হয়, সেসব কর্মকান্ডে এধরণের ব্যক্তিরা খুব সফল হয়ে থাকেন। এদের দুর্বলতা হলো, এরকম ব্যক্তিত্বের মানুষদের অন্যান্য মানুষদের কাছে কিছুটা আবেগ অনুভূতিহীন বলে মনে হতে পারে, কেননা তারা যুক্তি প্রমান এবং নিয়ম কানুন এর বাইরে গিয়ে কিছুই করতে পারেন না। C টাইপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিখ্যাত মানুষের উদাহরণ হলো Bill Gates এবং Albert Einstein.

এই ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষদের সাথে যেকোনো কাজে তাদের শক্তিশালী দিকগুলো প্রশংসার সাথে সাথে তাদের অভিযোজনযোগ্যতারও স্বীকার করা জরুরি। যেকোনো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিত্বের মানুষদের সুগভীর জ্ঞান এবং সমস্যা সমাধানের যোগ্যতাকে কাজে লাগানো অত্যন্ত ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে।

ব্যক্তিত্বের ধরণ ৪ প্রকার হলেও খুব কম মানুষই কেবল একটি মাত্র প্রকারের ব্যাক্তিত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই ২ প্রকারের মিশ্র ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দেখা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো আপনি কোন প্রকারের ব্যক্তিত্বের অধিকারী? এটি জানতে চাইলে আপনি অনলাইনে কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার মাধ্যমে আপনার কিংবা আপনার আশেপাশের মানুষের DISC Profile জেনে নিতে পারেন যেটা পরবর্তীতে আপনার নিজের এবং আশেপাশের মানুষের অনেক ব্যবহারের কারণ নির্ণয় করতে এবং একই সাথে তাদের প্রতি কিরূপ আচরণ করলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন।