বেদনা ও সংহতির স্মারক ক্রাইস্টচার্চ
শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯ সাল। বছর শেষ হলেও দিনটি বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে বেদনা ও সংহতির স্মারক রূপে। এদিন সারা পৃথিবীর সবার চোখ ছিল নিউজিল্যান্ডের দিকে।
দেশটির দু'টি মসজিদে সক্রিয় বন্দুক হামলায় ধর্মীয় সমাবেশরত শান্তিপূর্ণ মানুষের নির্মম হত্যাকাণ্ডে বিমূঢ় হয়েছিল বিশ্বমানবতা। দেশটির নিরাপত্তা ও সামাজিক শান্তি নিয়েও তৈরি হয় বহু প্রশ্ন।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড বিশ্বের নিরাপদ ও পরিবেশগত ভারসাম্যপূর্ণ দেশের তালিকার উপরের দিকে অবস্থান করে। পার্শ্ববর্তী অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকার কানাডা, ইউরোপের সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কের সঙ্গে মানব উন্নয়ন ও নিরাপত্তা সূচকে শীর্ষের দিকে থাকে দেশটি। এমন একটি দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে সকলের সামনে গণহত্যার আদলে পাখির মতো মানুষ খুন করা হয়। মসজিদে প্রার্থনারত ৫১ জন মানুষকে হত্যার পাশাপাশি ঐ সন্ত্রাসী ঘটনায় আহত হন শতাধিক।
উগ্র খ্রিস্টাবাদ ও শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার বেনটন টেরেন্ট শুধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই শান্ত হয়নি, ফেসবুক লাইভে সেই নির্মম বর্বরতা প্রচার করে উল্লাসের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে প্রশ্ন উঠে, প্রকাশ্যে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড কীভাবে সম্ভব হলো? আইনের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি এতোই শিথিল সেখানে? অস্ত্র বহন, হত্যাকাণ্ড সংগঠন ইত্যাদি চরম অপরাধমূলক কাজ থামানোর আগাম ব্যবস্থা বলতে সেখানে কি কিছুই নেই?
পাশেই অবস্থান করছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট দল। যাদের উপরও পড়েছিল সন্ত্রাসী হামলার আঁচ। ফলে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এই নারকীয় ঘটনায় ছিল উদ্বিগ্ন। বিশ্বের শান্তিকামী ও ক্রীড়ামোদী মানুষ ছিল উৎকণ্ঠায়।
এইসব হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র হামলার পেছনে পশ্চিমা উগ্র জাতীয়তাবাদী, খ্রিস্ট মৌলবাদীদের পাশাপাশি পশ্চিমা সরকারগুলো সমভাবে দায়ী করা হয়। কারণ, সেসব সরকার মুসলিম বিরোধী মনোভাব লালন ও পৃষ্ঠপোষণ করে। কিন্তু নিউজিল্যান্ড সরকার স্থাপন করে অনন্য দৃষ্টান্ত। তারা দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এবং সন্ত্রাস বিরোধী সংহতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন শুধু সরকার নয়, সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান। মুসলিম প্রথা, পোষাক, সংস্কৃতিকে ধারণ করে জনতা জানায় সংহতি। উচ্চারিত হয় 'আমরা সবাই মুসলিম' ধ্বনি।
অপরাধীদের আটকের পাশাপাশি ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে আধা-সামরিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয় দেশটিতে। পশ্চিমা বিশ্বে সন্ত্রাস দমনে অন্ধভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর বদলে কার্যকর, সঠিক পদক্ষেপ নেয় নিউজিল্যান্ডের সরকার ও জনতা।
নিউজিল্যান্ডে সংগঠিত নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির আগেও ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, আমেরিকাসহ অনেক পশ্চিমা দেশে মুসলিমরা আক্রান্ত হয়ে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আরো স্পষ্ট করে বললে, ২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিম বিদ্বেষের যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নিউজিল্যান্ডের ঘটনা তারই ধারাবাহিক কুফল ছিল। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মুসলিমদের মতো একটি বড় ও শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে সন্দেহ ও আক্রান্ত করার পশ্চিমা নীতির ভয়াবহ প্রকাশ ঘটছে এইসব আক্রমণ ও গণহত্যার মাধ্যমে।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ঘটনা ঘৃণাকে বাড়তে দেয়নি। সঠিক আইনগত পদক্ষেপ এবং সর্বধর্মের ঐক্য সাধন করেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। অন্য কোনও সন্ত্রাসী ঘটনায় এমন নজিরবিহীন ঐক্য আগে আর হয়নি। আক্রান্ত মুসলমানরা জীবন ও রক্ত দেওয়ার পরেও প্রতিশোধ নয়, ত্যাগ ও ক্ষমার আর্দশের ভিত্তিতে শান্তির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষেও ছিল মুসলিমদের প্রতি অভূতপূর্ব সমর্থন ও সংহতি।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনা সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতায় নতুন মাত্রা সংযেজন করে। বেদনা ও আত্মত্যাগের পরেও যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে সংহতি বজায় রাখা সম্ভব, নিউজিল্যান্ড সে প্রমাণ দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মুসলিম ও সমগ্র জনতা বিশ্বকে এই বার্তা দিয়েছে যে, সর্বাবস্থায় সন্ত্রাস হলো ঘৃণার ও প্রতিরোধের বিষয়।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনার আরেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো এটাই যে, পশ্চিমাদের দ্বারা ঢালাওভাবে মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলা আসলে মস্ত বড় ভুল ও অন্যায়। সন্ত্রাসী আক্রমণের কবলে জীবন ও রক্ত দিয়ে শান্তি সমুন্নত রেখে মুসলমানরা নিজেদের স্বচ্ছ অবস্থানকে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করেছে সারা বিশ্বে। নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় বিশ্ব জেনেছে, সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক সমস্যা, মুসলমানদের এককভাবে এর জন্য দায়ী করা অন্যায়। বরং মুসলিম বিদ্বেষ বন্ধ করে সবাই মিলে সন্ত্রাসের প্রতিরোধ করাই কর্তব্য।