রায় কার্যকরের অপেক্ষায় না.গঞ্জের রতনের পরিবার

  • সাবিত আল হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নারায়ণগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রতনের পরিবার, ছবি: বার্তা২৪.কম

রতনের পরিবার, ছবি: বার্তা২৪.কম

ফতুল্লার গাবতলী এলাকায় পুরো পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন রতন শিকদার। স্ত্রী-সন্তান মাকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ছিল সীমাহীন ভালোবাসা। শেখ হাসিনার ভাষণ মাইক থেকে নয় তার কণ্ঠেই শুনতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। সমাবেশের ভিড় পেরিয়ে মঞ্চের সবচেয়ে কাছাকাছি যাওয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টেও সেই অভ্যাসের ব্যতিক্রম হয়নি। আর সেই আগ্রহই কেঁড়ে নিয়েছিলো রতন শিকদারের প্রাণ।

রতন শিকদার রোলিং মিলের ব্যবসা করতেন। ২১ আগস্ট সভায় উপস্থিত হন অন্যান্য নেতাকর্মীদের মতই। শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হতেই বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। আহত অবস্থায় রতন শিকদারকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখানেই দেখা হয় তার স্বজন ফারুকের সাথে। ফারুক জানিয়ে দেন রতনের পরিবারকে। কিন্তু রতনের ছোট ভাই ভাই টুটুল শিকদার খবর পেয়ে হাসপাতালে আসতে আসতেই তার মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে টুটুল শিকদার বলেন, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ৩নং ওয়ার্ডের ৯নং বেডে ভাইকে দেখে আমি ব্যাপক খুশি হই। আহত হলেও ভাই আমার বেঁচে আছে। ছুটে যাই বেডের পাশে। বেডের পাশে যেতেই পাশের নার্স বলেন, ওনি তো নাই, ওনি মারা গেছেন। কিন্তু আমার ভাইকে দেখে একটুও বোঝা যাচ্ছিল না, তিনি যে মারা গেছেন। ভাইয়ের পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল। কিন্তু গায়ে আঘাতের কোন চিহ্ন ছিল না। ভাইয়ের মাথায় হাত দিলাম, শরীরটা আমার সাথে সাথে শিউরে উঠে। হাতের আঙ্গুল গুলো ব্যান্ডেজসহ ভিতরে ঢুকে গেলো। ভাইয়ের মাথার পিছনের প্রায় ৩ ইঞ্চি নেই। রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে, তাই বলে এভাবে মেরে ফেলতে হবে? কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন টুটুল শিকদার।

তিনি আরো বলেন, 'ভাইয়ের মৃত্যুর পরেও স্বস্তি পাইনি। দাফনের পরদিন থেকে বাড়িতে পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। নিজেকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত ভাইয়ের মৃত্যুর ২০ দিনের মাথায় দেশ ছেড়ে কুয়েত চলে যাই। তখন মনে হয়েছে আমি যেন দোষী, দেশ ছাইড়া পালাইলাম। নিজের ভাই হারাইছি, দেশও ছাড়ছি। ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমি ছিলাম পরিবারের কর্তা। নিজেকে সে সময় সবচেয়ে বেশি অসহায় মনে হইছে'।

বিজ্ঞাপন

ভাইয়ের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি করে বলেন, ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা হয়। তার ১৮ বছর পরে এ ঘটনায় মামলার রায় হয়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও রায় কার্যকর হয়নি এখনো। ভাই তো আর ফিরে পাবো না, আশা করি, দ্রুত ভাইয়ের হত্যাকারীদের রায় কার্যকর হবে।

রতনের ছোট ভাই ভাই টুটুল শিকদার

আক্ষেপ নিয়ে মারা যান রতন শিকদারের মা

রতন শিকদার ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। আর সে হিসেবে মা মমতাজ বেগমের কাছেও তিনি ছিলেন আদরের। যে সন্তানের জন্মে প্রথম মা হওয়ার উপলব্ধি পেয়েছেন, তাকে হারিয়ে আধপাগল হয়ে পড়েন সেই মা। মৃত্যু পূর্বে চেয়েছেন ছেলে হত্যার আসামির বিচার হোক। শেষ ইচ্ছে ছিল, ছেলে হত্যার বিচার। তবে সেই ইচ্ছে তার পূরণ হয়নি। ২ বছর পূর্বে তিনি মনে আক্ষেপ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেন।

টুটুল শিকদার মায়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার মায়ের মৃত্যুকালে বয়স হয়ে গিয়েছিল অনেক। সে সাধারণত টেলিভিশন দেখত না। কিন্তু ১৫ আগস্ট আর ২১ আগস্ট সারাদিন টেলিভিশনের সামনে বসে থাকত মা। সারাদিন চোখের পানি টপটপ করে পড়ত তার। আম্মা প্রায়ই বলত, 'কেন যে রতন তুই এতো আওয়ামী লীগের পাগল ছিলিরে! এতো বছর পরেও তোর হত্যাকারী গো ফাঁসি হইলো না'। মৃত্যুর আগেও অসুস্থ অবস্থায় মনের অবচেতনে রতন ভাইকে খুঁজত। তার আক্ষেপ থেকেই গেলো যে সে তার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারলো না।

দুঃস্বপ্নই সত্যি হয়েছিলো সেদিন

গ্রেনেড হামলায় নিহত রতন শিকদারের মৃত্যুর পর অসহায় হয়ে পড়ে তার স্ত্রী পরিবার। তারা চলে আসেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে। ভাইয়ের সহযোগিতায় জীবন অতিবাহিত শুরু করেন। রতন শিকদারের স্ত্রী রোজি বেগমের সাথে আলাপচারিতায় উঠে আসে স্বামী হারানো ও পিতাবিহীন সন্তানদের জীবনের কিছু ঘটনা।

রোজি বেগম নিজেদের জীবনের কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, মৃত্যু অবস্থায় আমার স্বামীর ব্যবসায়ের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ২০০৪ সালে আমাদের এক লাখ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া আমাদের সরকার থেকে প্রতি মাসে ৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমার সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়া হয়। এখন আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় কোনো রকমে চলছি এখন।

মৃত্যুকালে রতনের বড় ছেলে নিয়াজুল হক আনন্দের বয়স ছিল দশ। আর মেয়ে আমেনা জাহান স্বপ্নার মাত্র চার বয়স ছিল। রতন শিকদার তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করতেন। রোজি বেগম ২১ আগস্ট সকালের স্মৃতি মনে করে বলেন, সেদিন সকালে আনন্দের বাবা ঘুম থেকে উঠে বলেন, 'রাতে স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি, কিন্তু মেয়ে আমার হারিয়ে গেছে। আমার মেয়েকে দেখে শুনে রাইখো। কিন্তু সে যে গেলো, আর ফিরে আসেনি। মেয়ে তো হারায়নি, বাবা হারিয়েছে। সেদিন রাতের দুঃস্বপ্নই সত্যি হয়েছিল'।

নিহত স্বামী হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, আমার সন্তানরা অল্প বয়সে পিতার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পিতার ছায়া হারিয়েছে। আমাদের জীবন আজকে ভিন্ন হতে পারত। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন। তার কাছে গিয়েই আমার স্বামী প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রেনেড হামলায় মামলার রায় হয়েছে, আসামিদের শাস্তি হয়নি। এই রায় দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।