মেঘনা কখনো আশীর্বাদ, কখনো অভিশাপ
দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী মেঘনা। লক্ষ্মীপুরের ৪টি উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে এ নদী। এর ভাঙনে হারিয়ে গেছে এই জনপদের কয়েকটি গ্রাম। নিঃস্ব হয়ে গেছে কয়েক হাজার মানুষ। আবার এই নদীটিই জেলার প্রায় ৬০ হাজার জেলের আহারের জোগান দেয়। তাই এই উপকূলীয় জনপদের জন্য মেঘনা কখনো আশীর্বাদ, আবার কখনো অভিশাপে পরিণত হয়।
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে মেঘনা। এর ভাঙনে এসব উপজেলার অনেক গ্রামই বিলীন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে সর্বহারা মানুষের মনে পুষে রাখা স্বপ্নগুলো। সবকিছু হারিয়ে অনেকেই এখন নিঃস্ব হয়ে অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছেন। অনেকেই বেড়িবাঁধ কিংবা রাস্তার পাশে কোনো রকমে মাথা গুঁজে বেঁচে আছেন। মেঘনার ভাঙন এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রতিদিনই উপকূলীয় বাসিন্দাদের চরম আতঙ্কে কাটাতে হয়।
এদিকে এখন নদীতে চলছে নিষেধাজ্ঞা। মাছ শিকারে যাচ্ছে না জেলেরা। গত ৭ অক্টোবর থেকে এ নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়। চলবে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়টুকু এখানকার জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের ছেঁড়া-ফাটা জাল বুনছে, আবার কেউ নৌকা মেরামত করছে। তবে অধিকাংশ জেলেই অলস সময় কাটাচ্ছে।
জানা গেছে, জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতির বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীর ভাঙনে ছোট হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম, কয়েকশ একর জমি, ভিটে-মাটি এমনকি পূর্ব-পুরুষের কবরগুলোও। এক সময় কয়েক একর জমির মালিক থাকলেও এখন সব হারিয়ে তারা নিঃস্ব। এগুলো চিন্তা করলেই মনে হয় মেঘনা আসলেই অভিশাপ। তবুও মেঘনাকে ছাড়তে নারাজ তারা। ঘুরে ফিরে মেঘনার পাড়েই বসতি স্থাপন করছে তারা।
এই জেলাতে প্রায় ৬০ হাজার জেলে রয়েছে। যাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম হল মেঘনা নদী। একদিন নদীতে না গেলে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নদীতে মাছ না পেলে ও নিষেধাজ্ঞার সময় সেই কষ্টগুলো চোখে পড়ে। কিন্তু নদীতে নেমে যখন ইলিশ শিকার করে ঘাটে আসে তখন জেলেদের চোখে মুখে অনাবিল আনন্দ দেখা যায়। তখন মনে হয় আসলেই মেঘনা তাদের জন্য আশীর্বাদ।
সম্প্রতি কমলনগরের মতিরহাট এলাকায় বেড়িবাঁধের নিচে নদীর কিনারা ঘেঁষে দলবেঁধে জাল বুনতে দেখা যায় কয়েকজন জেলেকে। এ সময় আবুল হায়াত ও ফারুক হোসেন নামে দুইজন জেলে বলেন, ‘আমাদের দু’জনের বাড়িই সাহেবের হাট এলাকায় ছিল। নদী আমাদের বাড়ি-ঘর সব ভেঙে নিয়ে গেছে। প্রায় ৪ বছর হল বেড়িবাঁধের পাশে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছি।’
জানতে চাইলে তারা আরও বলেন, ‘অইতে হারে আঙ্গো বেজ্ঞিন নদী লই গ্যাছে (হতে পারে আমাদের সবকিছু নদী নিয়ে গেছে)। হিয়ার হরে নদীর তন-ই আঙ্গো ইনকাম আইয়ে (তারপরও নদী থেকেই আমাদের উপার্জন আসে)। ইয়ার লাই ছাড়ি যাইতে হাইত্তাছি না (এজন্যই ছেড়ে যেতে পারছি না)। আর হাইত্তামও ন (কখনো পারবোও না)। মইরলেও ইয়ানে বাঁইচলেও ইয়ানে (মরলেও এখানে বাঁচলেও এখানে)।
সদরের চররমনী মোহনের জেলে আবুল কাশেম রাজন বলেন, ‘আমি অন্যের নৌকাতে কাজ করি। নদীতে যাওয়া ছাড়া কোনো উপার্জন হয় না। নিষেধাজ্ঞার সময় এখন কোনো কাজ নেই। তাই ছেঁড়া-ফাটা জালগুলো বুনছি।’