লন্ডনে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের আরও একটি বিনা মূল্যে পাওয়া ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী উত্তর লন্ডনের ওই ফ্ল্যাটটি তার পরিবারকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।
টিউলিপ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।
শনিবার (৩ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এর আগে টিউলিপ সিদ্দিক ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রসের কাছে একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছিলেন কোনও অর্থপ্রদান না করেই, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস গত শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে। মূলত পূর্বে অপ্রকাশিত ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ফাইলিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি এই তথ্য সামনে এনেছে।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি উত্তর লন্ডনের ওই ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বোন আজমিনা সিদ্দিকের নামে হস্তান্তর করেন। পরে আজমিনা বিনামূল্যে এই ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে ব্যবহার করতে দেন।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, টিউলিপ উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের এমন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি তাঁর পরিবারকে দিয়েছেন তাঁর খালা শেখ হাসিনার এক মিত্র। হ্যাম্পস্টেডের ফিঞ্চলে রোডের এই ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন আজমিনাকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে ‘গণহত্যা, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। এই অভিযোগের মধ্যে অন্তত ৮০০ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর বিষয়টি আছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগও রয়েছে।
শেখ হাসিনা পরিবারের যেসব সদস্য সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে টিউলিপও আছেন। তবে তিনি কোনো অন্যায়-অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, টিউলিপের ওপর তাঁর আস্থা রয়েছে।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, মঈন গনি — একজন বাংলাদেশি আইনজীবী যিনি হাসিনার সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছবিতেও তাকে দেখা গেছে — ২০০৯ সালে হ্যাম্পস্টেডের ওই সম্পত্তিটি আজমিনার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
ভূমি রেজিস্ট্রি নথিতে বলা হয়েছে, ওই ফ্ল্যাটের জন্যও কোনও অর্থ পরিশোধ করতে হয়নি টিউলিপ বা আজমিনাকে। আজমিনার বয়স তখন ছিল ১৮ বছর এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সেসময় তিনি কেবল পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। এরপর সেখানে থাকতে শুরু করেন বড় বোন টিউলিপ সিদ্দিক।
টিউলিপ ঠিক কখন ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ ওয়ার্কিং মেনস কলেজের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি নথিতে তাঁর ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটি তালিকাভুক্ত করেন।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্যামডেন আর্টস সেন্টারের ট্রাস্টি হওয়ার পর, ২০১৪ সালের মার্চে হ্যাম্পস্টেড ওয়েলস অ্যান্ড ক্যাম্পডেন ট্রাস্টের ট্রাস্টি হওয়ার পরও তিনি একই ঠিকানা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তাঁর স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত এটিকে তাঁর ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন। তখন টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার এমপি ছিলেন।
টিউলিপের বোন আজমিনার টনি ব্লেয়ার’স ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সম্প্রতি শিশুদের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন। তিনি ফ্ল্যাটটি ২০২১ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেন।
ফ্ল্যাটটির আগের মালিক আইনজীবী মঈন গণি আন্তর্জাতিক বিরোধসংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক বছর বাংলাদেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকার বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলে দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার কাছ থেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ-সংবলিত একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাওয়াটা তাঁর জন্য সম্মানের বিষয়।
হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি থেকে ভিন্ন। কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি ২০০৪ সালে টিউলিপ বিনা মূল্যে পান। তিনি এখনো এই অ্যাপার্টমেন্টটির মালিক।
এর আগে গত শুক্রবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি টিউলিপকে বিনা মূল্যে দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তিনি শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সহযোগী।
হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটির বিষয়ে টিউলিপ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁর বোনের এই ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করেছিলেন, যা অনেক পরিবারের জন্য সাধারণ একটি বিষয়।
২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক শক্তি চুক্তিতে টিউলিপ মধ্যস্থতা করেছেন, এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন বলে যে অভিযোগ, তা অনুসন্ধান করার কথা সম্প্রতি জানায় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের এই ঘোষণার পর টিউলিপ তদন্তের মুখে। তবে টিউলিপ বলেছেন, তিনি ভুয়া অভিযোগের ভুক্তভোগী।