নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ‘আলতাদিঘী পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পের জন্য দিঘীটির চতুর্দিকের কয়েক হাজার গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে সাধারন মানুষের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবাদকারীদের অভিযোগ, কিছুদিন আগেও আলতাদীঘি ছিলো সবুজের আভা। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এখন খাঁ খাঁ করছে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান। সম্প্রতি উদ্যানের দীঘি খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও গাছ রোপনসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়ে নানা প্রজাতির হাজারো গাছ।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে সাব্বির হোসেন বন্ধুকে সাথে নিয়ে এসছেন আলতাদীঘি দেখতে। কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। তারা ক্ষোভের সাথে বলেন, দিঘীটি অবশ্যই সংস্কার জরুরী কিন্তু তাই বলে এভাবে নির্বিচারে চর্তুদিকের সারিবদ্ধ সব গাছগুলো কাটতে হবে? গাছগুলো রেখে কি সংস্কার করা যেতোনা? দিঘীর চতুর্দিক দেখে এটাকে আর দিঘী বলা যায়না । এ যেন এক মরুভূমি।
উদ্যানের উন্নয়ন কাজে গঠিত কমিটির সদস্য কায়েস উদ্দিনের দাবি, আলোচনা সভায় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়নি। হঠাৎ করে আলতাদিঘীতে এসে দেখি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।
তবে ধামইরহাটের বনবিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলছেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। নতুন বনায়ন হবে, একটা গাছ তো আর সারাজীবন থাকবে না। এটি সামাজিক বনায়নের অওতায় স্বল্প মেয়াদি সৃজিত উডলট বাগান।
বন বিভাগ বলেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়নকৃত গাছগুলি অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আলতাদিঘীর খননকৃত মাটি দিয়ে নীচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য দীঘির চারপার্শ্বে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৫টি লটে ৩৫,৯৫,২৫৬/- (পঁয়ত্রিশ লক্ষ পঁচানবাই হাজার দুইশত ছাপান্ন) টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়।
এখানে ঘুরতে নওগাঁ শহরের একটি কলেজ এর শিক্ষার্থী লুবনা ইয়াসমিন বলেন, ‘গাছ কাটার আগে এসব জায়গাতে বেশ কিছু পাখির বাসা দেখেছি। এখন সেখানে বালুর স্তুপ। এগুলো মেনে নেয়া যায়?
পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই অযুহাতে ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার বিষয়টি হয়তো মেনে নেয়া যায় তবে দিঘীর চতুর্দিকে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো পরিবেশ বান্ধব বিশাল আকৃতির ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ কাটার বিষয়টি অযৌক্তিক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাফকুল ইসলাম বলেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধন বৃক্ষরোপনের মধ্যে নিহিত, নিধনে নয়। আজকের কর্তনকৃত গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ নিমিষের মধ্যে তা ধংস করা হচ্ছে। আধুনিক নকশায় গাছ রেখেই সুন্দর পরিকল্পনা করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান এঅঞ্চলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। আমরা এবিষয়ে অনেক মিটিং মিছিল মানববন্ধন করেছি কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। পুরানো হাজার হাজার গাছগুলো যারা নির্বিচারে কাটছেন তারা অবশ্যই অপরাধ করছেন। এসব উদ্যেশ্য প্রনোদিত।’
রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান এ বিষয়ে জানিয়েছেন, আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত আলতাদীঘিটি দীর্ঘদিন যাবত খনন ও সংস্কার না করার কারণে দীঘিটির গভীরতা কমে গিয়ে প্রায় ১ ফুটের উচ্চতার নিচে পানি ছিল এবং চারপাশের পাড়গুলো ভেংগে যাওয়ায় দীঘিটি পুন:খনন ও পাড় সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬৪৯.৯৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বন অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মাধ্যমে দীঘিটির খনন কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। খননকৃত মাটি দিয়ে দীঘিটির চর্তুপার্শ্বের পাড় মেরামত ও উচুকরণ করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। আলতাদীঘির পাড় জুড়ে সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়নকৃত গাছগুলি অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করা হয়।
পুকুরের খননকৃত মাটি দিয়ে নীচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য আলতাদীঘির চারপার্শ্বে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমনিগাছ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ১৫টি লটে ৩৫,৯৫,২৫৬/- (পঁয়ত্রিশ লক্ষ পঁচানবাই হাজার দুইশত ছাপান্ন) টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রয় করা হয়েছে। এ অর্থ সংশ্লিষ্ট ১৬ জন উপকারভোগীগণের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের চারিপাশে বিদ্যমান গাছগুলো স্থান উপযোগী না হওয়ায় গাছগুলি কর্তন করে দেশীয় প্রজাতির চারা দ্বারা চলতি অর্থবছরের বর্ষাকালে বনায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আলতাদীঘিটি ২.৫০ মিটার খনন করা হয় এবং বর্তমান তাপদাহ ও তীব্র খড়ার কারণে দীঘিটি শুকিয়ে যায়।
"সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ সুরক্ষা প্রকল্পের" মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন আলতাদীঘির জলাশয়ের চারিপাশে ২ মিটার প্রন্থ ইটের সোলিং এবং পাকা রাস্তা তৈরী করা হবে এজন্য দীঘির পাড়ের ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছগুলি কর্তন করে আলতাদীঘির চর্তুপার্শ্বের পাড় মেরামত ও উচু করা হয়েছে।
দেশীয় প্রজাতির ৩০০০টি চারা দ্বারা দীঘিটির চারপাশে বনায়নসহ দীঘিটিতে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চলতি অর্থ বছরের নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে সমাপ্ত হলে পুরো আলতাদীঘি এলাকা আবারও সবুজে পরিণত হতে শুরু করবে। দীঘির পানির পাপ্যতা নিশ্চিত ও বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগোষ্টির কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচন এবং ইকো টুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
আলতাদীঘির নামকরণেও রয়েছে ঐতিহাসিক মজার ঘটনা। অনেক অনেক দিন আগের কথা। এ এলাকা ছিল বটু রাজার। জগদ্দলে ছিল সেই রাজার বাড়ি। তাঁর ছিল এক দয়াবতী রাণী। রাণী একদিন আবদার করলেন, তাকে বড় এক দীঘি খুঁড়ে দিতে হবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তুমি হাঁটতে শুরু কর। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার পা ফেটে রক্ত বের না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হাঁটতে হবে। এখান থেকে হাঁটা শুরু করে যেখানে গিয়ে পা থেকে রক্ত বের হবে সেই পর্যন্ত দীঘি কাটা হবে। রাণী হাঁটতে থাকলেন। হাঁটা আর শেষ হয় না। রাজা পড়ে গেলেন চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত পাশের দেশে গিয়ে দীঘি কাটতে না হয়। তাই কৌশলে তার সৈন্য দিয়ে রাণীর পায়ে আলতা লাগিয়ে বললেন, রানীর পা ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। দীঘি সে পর্যন্তই খোঁড়া হল। ধীরে ধীরে সে দিঘি ভরে গেল টলটলে কাকচক্ষু জলে। তাতে পদ্ম ফুটল। প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট শেষ হলো। আর সে থেকেই এর নাম হয়েছে আলতাদীঘি। প্রায় হাজার বছরের স্মৃতি নিয়ে আজও সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহ্যবাহী আলতাদীঘি।
এত প্রাচীন আর এমন বিশাল দীঘি বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ দীঘির দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার, চওড়া প্রায় ৪০০ মিটারের মতো। গ্রামের লোকমুখে প্রচলিত আছে বৌদ্ধ যুগের কীর্তি এটি। দীঘির পাড় ঘেঁষে ভারত সীমান্ত। উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া, বিএসএফের সীমান্ত টইল, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতকে দেখা খুবই সহজ। আলতাদীঘির পাড়ে দাঁড়ালে মনে হবে অনেকটাই সুন্দরবনের মতো, শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন ঘটে।