শুধু কয়লা আমদানিতে সীমাবদ্ধ হালুয়াঘাটের স্থলবন্দর!

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ময়মনসিংহ 
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর

আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থলপথে পণ্য আমদানি-রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। একই সাথে গুরুত্ব বাড়ছে স্থলবন্দরগুলোর। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরকে পুর্ণাঙ্গ ঘোষণা করা হয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর ঘোষণা করা হলেও রপ্তানি তো দুরে থাক, বছরে ৬ মাস শুধু ইট পোড়ানোর কয়লা আমদানির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে এই স্থলবন্দর। বছরের বাকি সময় মূলত বন্ধ থাকে বন্দরটি। তবে, আমদানি-রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞাপন

গোবরাকুড়া স্থল বন্দরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড় বড় কয়লার স্তুপ। তবে, স্থলবন্দর বিরাজ করছে শুনশান নিরবতা, নেই কোনো মানুষ। কয়লার স্তুপের মাঝে মাঝে রয়েছে ব্যবসায়ীদের বসার জন্য ঘর। ওই ঘরগুলোতেও তালা দেয়া। এরপরই চোখে পড়ে স্থল বন্দরের প্রশাসনিক ভবন। সেখানে গিয়েও গেইটের দারোয়ান ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি।

গোবরাকুড়া স্থল বন্দর থেকে কড়ইতলী স্থল বন্দরের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। কড়ইতলী স্থল বন্দরে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়, বড় বড় স্তুপ করে কয়লা রাখা হয়েছে। সেখানেও মানুষজন নাই। বন্দরের প্রধান ফটকে তালা দেয়া। সিকিউরিটি গার্ডের কাছে দেয়ার পর পরিচয় দেয়ার পর গেইট খুলে দেন তিনি। ভিতরে রয়েছে আমদানি-রপ্তানি করার সকল সুবিধা। 

বিজ্ঞাপন
বছরে ৬ মাস শুধু কয়লা আমদানিতে সীমাবদ্ধ হালুয়াঘাটের স্থলবন্দর

যেভাবে শুরু গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর

১৯৭৯ সালে কড়ইতলী ও ১৯৯৭ সালে গোবরাকুড়া শুল্ক স্টেশনের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে কয়লা আমদানি শুরু হয়। কড়ইতলী ব্যবসায়ীদের নিয়ে কড়ইতলী কোল অ্যান্ড কোক ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন ও গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপ নামের দুটি সংগঠন সৃষ্টি হয়। এই দুটি সংগঠন কড়ইতলী-গোবরাকুড়া স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এরপর প্রায় ৬ বছর পার হলেও গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেনি। পরে ২০১৮ সালের ১ জুলাই ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১.১৪ একর জমির উপর গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ১১ মার্চ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায় নির্মিত ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর উদ্বোধন করেন। পরে ১৭ মে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের গোবরাকুড়া অংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নামাঙ্কিত উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।

পুর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে যে সকল সুবিধা রয়েছে

বন্দরের সিমানা প্রাচীর, বন্দরের অভ্যন্তরীণ সড়ক, ওপেন স্ট্যাক ইয়ার্ড, পার্কিং ইয়ার্ড, ৪০০ মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্য দুই ওয়্যারহাউজ, অফিস ভবন, ডরমিটরী ভবন, ব্যারাক ভবন ও পাওয়ার হাউজ, বন্দরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা, টয়লেট কমপ্লেক্স, আমদানী-রপ্তানী পন্যের সঠিক পরিমাপের লক্ষে ১০০ মেট্রিকটন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ৪ টি ডিজিটাল ওয়েব্রীজ স্কেলসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

এই বন্দরে আমদানি ও রপ্তানি যোগ্য পণ্যসমুহ

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর দিয়ে প্রধানত কয়লা ও পাথর আমদানী হয়ে থাকে। তাছাড়া, তাজা ফলমুল, গাছপালা, বীজ, হম, রাসায়নিক সার, চায়না-ক্লে, কাঠ, টিম্বার, চুনা পাথর, পেয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, ফুল ঝাড়ু, ডাব, হলুদ, কাজু বাদাম, তেতুল, তীল, সরিষা, ভুসি, চাউলের গুড়া, গবাদিপশু ও মাছের পোনা আমদানিকরণের অনুমোদন রয়েছে। তবে, সিমেন্ট, প্লাস্টিক পন্য, শিশুখাদ্য রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে।

যেভাবে চলছে গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর

ভুটানসহ ভারতের সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। লক্ষ্য ছিল, ভুটান-ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কয়লা, পাথর, মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, বাঁশ, পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি-রফতানি করা। কিন্তু এখন এই বন্দরের কার্যক্রম শুধু কয়লা আমদানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কয়লা আমদানীর কার্যক্রম চলে ৬ মাস। বছরের বাকি সময় এই বন্দর কার্যত বন্ধই থাকে।

কর্মসংস্থান

হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দুইটি পোর্টে অন্তত ৫ শতাধিকের বেশি আমদানী কারক রয়েছে এবং প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক রয়েছে। আমদানি বন্ধ থাকলে আমদানিকারকরা বেকার হয়ে পড়েন। এদিকে, পোর্টে কর্মরত শ্রমিকরা অন্য কাজ করে সংসার চালান। তাদের দাবি, এই দুটি পোর্ট দিয়ে আমদানীর সাথে পন্য রপ্তানী করা গেলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পেত ও এর সংশ্লিষ্ট সকলের ভাল ব্যবসা বা আয়-রোজগার হত।

ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের ৬ মাসে বন্দরে লাভ

স্থল বন্দর সুত্র জানায়, গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দুইটি পোর্ট দিয়ে চলতি বছরে জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৬৮৮ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে। জানুয়ারীতে ১৪ হাজার ১৫২ মেট্রিক টন, ফেব্রুয়ারীতে ১২ হাজার ৭৫৩ মেট্রিক টন, মার্চে ১৪৫ মেট্রিক টন, এপ্রিলে ১১ হাজার ৬২১ মেট্রিক টন, মে'তে ১৫ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন এবং জুন মাসে ১৭ হাজার ৭৮৩ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে। আমদানি করা কয়লা থেকে ৬ মাসে বন্দর মাসুল (বন্দরের লাভ) ১ কোটি ৩১ লক্ষ ২১৮ টাকা। এর মাঝে ভ্যাট ধরা হয়েছে ১৯ লক্ষ ৭৩ হাজার ৪৫৯ টাকা।

গোবরাকুড়া স্থল বন্দরের মাসুদ ট্রেড লিমিটেডের মালিক মাসুদ করিম শান্ত বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কয়লা ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কারণ, একটা মামলার জন্য কয়লা আমদানী বন্ধ ছিল। কোর্ট নির্দেশেনা দিলে কিছু দিন কয়লা আসছে। আবার কিছু দিন পরে বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবেই কেটেছে ৮ বছর। ২০২৩ সালে কয়লা আমদানী শুরু হয়েছে। এখন কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।’

গোবরাকুড়া আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের মহাসচিব অশোক সরকার অপু বলেন, ‘বছরে ৬ মাস কয়লা আমদানি করা হয়েছে। পাথর আমদানি করার পরিকল্পনা আছে। আমাদের অপর পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য দিয়ে বাংলাদেশে পন্য আমদানি করতে হয়। এলাকাটা জঙ্গলের মত হওয়ায় আমদানি করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়। যে কারণে শুধু কয়লা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছি। তবে, ফলমুল, মসলা জাতীয় কিছু পন্য আমদানি করার চেষ্টা করছি। এই পোর্ট দিয়ে কোনো পন্য এখন পর্যন্ত রপ্তানী করার সুযোগ হয়নি। তবে, আমরা পন্য রপ্তানি করার চেষ্টা করছি।’

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই বছরের জানুয়ারী থেকে জুন মাস পর্যন্ত শুধু কয়লা আমদানি হয়েছে। অন্য কোনো পন্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়নি। এছাড়া এই দুটি পোর্ট দিয়ে বছরে ৬ মাস শুধু কয়লা আমদানি হয়। বাকি ৬ মাস এখানে কোনো কাজ থাকে না। এই সময়টাতে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে পড়েন।’