রুনা আজ হাজারো তরুণীর অনুপ্রেরণা

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

৯ বছর আগের এক বিকেল। যানজট ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে বড্ড দেরি হচ্ছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে কর্মরত খতিজা বেগম রুনার। একদিকে অফিস শেষে দীর্ঘ ভ্রমণের যন্ত্রণা, অন্যদিকে মায়ের কাছে রেখে আসা পাঁচ মাসের শিশুও কষ্ট পাচ্ছিল খুব। শেষমেশ বাসায় ফিরলেও লেগে যায় অনেকটা সময়। রুনার সেই সমস্যা যেন এক লহমায় মিটিয়ে দিলেন বাবা। দুগ্ধজাত নাতিকে নিয়ে মেয়ের দুশ্চিন্তা দেখে রুনাকে তাঁর বাবা বললেন, ‘মা স্কুটি চালানো শুরু কর, তাহলে দ্রুত আসা-যাওয়া করতে পারবি।’ যেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো-স্কুটি নিয়ে রুনার পথচলা।

২০১৫ সালে নিজের প্রয়োজনে স্কুটি চালানো শুরু করা সেই রুনা এখন অন্য নারীদের অনুপ্রেরণা। গত ৭ বছরে চট্টগ্রাম শহরের অন্তত ২ হাজার ৮০০ জন নারী স্কুটি চালানো শিখেছেন তাঁর কাছ থেকে। রুনার কাছ থেকে স্কুটি চালানো শিখে তাঁদের বেশির ভাগই এখন নিয়মিত অফিসে যাওয়া-আসা করছেন স্কুটি চালিয়ে। কেউ কেউ আবার রাইড শেয়ারিং ও খাবার সরবরাহের কাজ করে আয়ও করছেন। আবার কেউবা শেখাচ্ছেন অন্য নারীদেরও। রুনা তাই হয়ে উঠেছেন বন্দরনগরীর তরুণীদের ‘আইডল’।

বিজ্ঞাপন

শুরুর সেই দিনগুলো: অন্যদের শেখানোর শুরুটা কীভাবে, এমন প্রশ্নে রুনা ফিরে গেলেন অতীতে। সড়কে শাঁ শাঁ করে স্কুটি চালিয়ে রুনাকে অফিসে আসা-যাওয়া করতে দেখে অনেক নারীই উৎসাহিত হন। কেউ কেউ রুনাকে রাস্তায় থামিয়ে বাহবা দিতেন। আবার কেউবা বলতেন, তাঁদেরও শেখাতে। তবে কর্মব্যস্ততার কারণে শেখানোর কাজটা তখনো শুরু করা হয়ে ওঠেনি রুনার। তবে ২০১৭ সালের শুরুতে রুনা নামেরই আরেক তরুণীর বেশ আগ্রহ দেখালে আর ‘না’ বলতে পারেননি। ওই তরুণীকে ছুটির দিন শুক্রবার সিআরবির শিরীষতলায় স্কুটি চালানো শেখানো শুরু করেন রুনা। সেটি দেখে আশপাশের অনেক নারীও জড়ো হন। তাঁদেরও একই কথা, ‘আমিও শিখব’। এভাবে এই মুখ ওই মুখ হয়ে রুনার নাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো বন্দরনগরীতে।

নারীদের আগ্রহ আর কৌতুহল বাড়তে থাকলে ২০১৯ সালে রুনা ‘পঙ্খিরাজ’ নামের একটি পেজ খোলেন ফেসবুকে। এখন এই পেজেই জানিয়ে দেওয়া হয় সবকিছু। যেহেতু চাকরি করেন, সে জন্য রুনা ছুটির দুই দিন, শুক্র-শনিবার বেছে নেন নারীদের স্কুটি চালানো শেখাতে। এখন ওই দুই দিন সকাল ৭টা থেকে ৯টা এবং ৯টা থেকে ১১টা দুই ব্যাচে নারীদের শেখাচ্ছেন স্কুটি। তাঁর কাছ থেকে এখন পর্যন্ত স্কুটি চালানো শিখেছেন প্রায় ২ হাজার ৮০০ নারী। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন এখন নিজেরাই স্কুটি কিনে চালাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

রুনার ক্লাসে একদিন: সম্প্রতি এক শুক্রবার সিআরবির শিরীষতলায় গিয়ে দেখা গেছে, নারীদের নিজের স্কুটিতে বসিয়ে হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন রুনা। বলতে গেলে গাড়ি চালানোর এ টু জেট শিখিয়ে দিচ্ছিলেন রুনা। সেদিন তাঁর ক্লাসে ছিলেন অন্তত ৩০ নারী। সেই নারীদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক থেকে আইনজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে গৃহিণী। রুনার আন্তরিকতায় তরুণীরাও দ্রুত রপ্ত করছিলেন গাড়ি চালানো।

রুনার কাছ থেকে স্কুটি চালানো শেখাদের একজন অঞ্জনা চৌধুরী। যাত্রীবাহী গাড়িতে নানা হয়রানি ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে বেশ কয়েকবছর আগে স্কুটি চালানো শেখেন এই শিক্ষিকা। রাঙ্গুনিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত এই নারী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘স্কুলে যেতে অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছেন রুনা। তাঁর কাছ থেকে স্কুটি চালানো শেখার পর এখন আমি নিজেই স্কুটি চালিয়ে যাওয়া-আসা করছি।’

রুনার কাছে কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই অঞ্জনার। স্কুটি চালানো শিখতে শিখতে বন্ধু হয়ে উঠা এই তরুণী একরাশ প্রশংসায় ঝরালেন রুনাকে। বললেন, ‘রুনা নিজে তো এগিয়ে গেছেই। সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সমাজের আরো কিছু নারীকে। যারা আজকে স্কুটি শিখে নিজের যাত্রাপথ সহজ করেছে, সঙ্গে তার পুরুষ সঙ্গীর দায় দায়িত্বও ভাগ করে নিয়েছে। চলতি পথে যখন দেখি কোনো স্কুলগামী ছোট্ট সন্তান তার মাকে জড়িয়ে আছে আর মা নামক সেই যাদুকর সাঁইসাঁই করে তার পঙ্খীরাজ নিয়ে ছুটে চলেছে ভীষণ মন ছুঁয়ে যায় এই দৃশ্য। নারীকে তার চ্যালেঞ্জিং জীবনে আরো একধাপ এগিয়ে দেওয়ার এই কাজের পেছনে রুনার অনিশেষ অবদান।’

দুই বছর আগে রুনার কাছে স্কুটি চালানো শিখে জান্নাতুল ফেরদৌস পুষ্পা এখন নিজেই অন্যদের স্কুটি চালানো শেখাচ্ছেন। পাশাপাশি নেমে পড়েছেন রাইড শেয়ারিং ও খাবার সরবরাহের কাজেও।

জান্নাতুল ফেরদৌস পুষ্পা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘একটা সময় স্কুটি চালানো ছিল স্বপ্নের মতো। তবে সেই স্বপ্নটা সহজ করে দিয়েছেন রুনা আপু। আমি তাঁর কাছ থেকে শেখার পর এখন নিজেই প্রতিদিন দুই বেলা অন্য নারীদের স্কুটি চালানো শেখাচ্ছি। পাশাপাশি রাইড শেয়ারিং ও খাবার সরবরাহের কাজও করে যাচ্ছি নিয়মিত। স্কুটি আমাকে যেমন সাহসী করেছে, তেমনি দিয়েছে স্বচ্ছলতা। এর পেছনে রুনা আপার অবদান অনেক।’

নিজের প্রয়োজনে স্কুটি চালানো রুনা একদিন অন্য নারীদেরও অনুপ্রেরণার কেন্দ্রতে থাকবেন, ভাবতেই এখনো এই তরুণীর একরাশ আনন্দ কাজ করে। সেটিই বলছিলেন বার্তা২৪.কমকে। বলেন, ‘একদিন নিজের প্রয়োজনেই স্কুটি নিয়ে সড়কে নেমেছিলাম। অফিস শেষে আমার সন্তানকে দ্রুত কাছে পাওয়াই ছিল এর প্রধান কার। সেটি তো হলোই, এখন আমার কাছ থেকে হাজারো নারী স্কুটি চালানো শেখে নিজেরাই চালাচ্ছেন। আমার কাছ থেকে স্কুটি চালানো শেখার পর অন্তত ৭০০ জন নারী স্কুটি কিনে নিজে চালাচ্ছেন। এর মধ্যে গত বছরেই দেড়শ নারী স্কুটি কিনেছেন। এখন আমার মতো এই নারীদেরও দীর্ঘক্ষণ গণপরিবহনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বাসে ধাক্কাধাক্কি খেতে হয় না, হয়রানির মুখে পড়তে হয় না। এখানেই তো আমার সার্থকতা। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু কি হতে পারে?’

শুধু কি স্কুটি চালানো শেখানো? না। এখন পঙ্খিরাজ হয়ে উঠেছে একটা পরিবার। ঈদের দিনগুলোতে কিংবা পূজার উৎসবে-স্কুটি নিয়ে তরুণীরা ছুঁটে যান শহরের এখানে ওখানে। স্কুটি চালাতে চালাতে মেয়েদের দল গাইতে থাকে-‘এই পথ যদি না শেষ হয়…, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো…’! আর সেই গাড়ি মিছিলের সামনে থেকে নারীদের পথ দেখান তাঁদেরই বড় আদরের ‘রুনা ম্যাম।’