৩০ জনকে ডিঙিয়ে ওয়াসায় প্রকল্প পরিচালক: দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতি মোস্তাফিজের!

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

৩০ জনকে ডিঙিয়ে ওয়াসায় প্রকল্প পরিচালক: দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতি মোস্তাফিজের!

৩০ জনকে ডিঙিয়ে ওয়াসায় প্রকল্প পরিচালক: দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতি মোস্তাফিজের!

কাজে অভিজ্ঞ না হলেও দুর্নীতিতে আগেই হাত পাকিয়েছেন তিনি। হয়ত সেটাই বড় গুণ হিসেবে দেখেছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ! ৩০ জন ঊর্ধ্বতনকে ডিঙিয়ে তাকে বসানো হয়েছে প্রকল্প প্রধানের পদে।

ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) পানি শোধনাগার প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান এই প্রকৌশলীর নাম মোস্তাফিজুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর দুই কোটি অধিবাসীর জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহে ওয়াসার রয়েছে একাধিক শোধনাগার প্রকল্প। দাপ্তরিক নিয়ম অনুযায়ী, ওয়াসার কোনো প্রকল্পের প্রধান বা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর। কিন্তু অনেকটা নিয়ম বহির্ভূতভাবেই একজন অপেক্ষাকৃত স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে জুনিয়র প্রকল্প পরিচালকের অধীনে ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে ওয়াসার প্রকৌশলীদের ভেতরে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এমন অনিয়মের প্রতিকার পেতে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের কাছে একটি প্রতিবাদ ও নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন অন্যান্য প্রকৌশলীরা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, দায়িত্ব পেয়েই দুর্নীতির ডালা সাজিয়ে বসেছেন প্রকৌশলী মোস্তাফিজ। বিদেশি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে বড় অংকের দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন এমন অভিযোগ সামনে এসেছে। অতিরিক্ত শর্ত ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বলা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত যোগ করিয়েছেন তিনি। এ সবের অভিযোগের তদন্তের দাবি জানিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুটি অভিযোগের চিঠির কপি বার্তা২৪.কমের হাতে এসেছে।

সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের পানি সরবরাহের পাইপ লাইন বসানোর প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে, অনিয়মের বিষয়ে তদন্তের দাবি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধি।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, পানি শোধনাগারের পাইপ লাইন প্রকল্পের দরপত্র পরবর্তী মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান জিপসামকে কাজ দিতে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের নির্দেশে সর্বোচ্চ প্রভাব খাটাচ্ছেন প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সরাসরি জোগসাজশ রয়েছে বলে সূত্রটি জানায়।

এরই ধারাবাহিকতায় এবার পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট ফেজ ৩-এর প্রাকযোগ্যতার ক্ষেত্রে ফরাসি প্রতিষ্ঠান ডিগ্রিমন্ট ও সুইজ ইন্টারন্যাশনালকে সুবিধা দিতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার সনদসহ নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে প্রশ্নবিদ্ধ টেন্ডারের শর্ত দিয়েছেন বলে প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ।

ইতোপূর্বে, সংগ্রহ বিভাগে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায়ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান অনেক দুর্নীতির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে সূত্রটি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবাদ চিঠিতে ক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা অভিযোগ করেন, ঢাকা ওয়াসার 'সায়েদাবাদ শোধনাগার ফেজ-৩' প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদমর্যাদার পদ হলেও ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসায় তার ওপরে প্রায় ৩০ জন ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও বিশেষ সুবিধা পাকাপোক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে।

বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে টেন্ডারে অতিরিক্ত শর্ত জুড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আমার কাছে এমন কোনো তথ্য কেউ চায় নাই। আর যে বিডার (দরদাতা) আসে, তারা যে তথ্য চায়, এমন কোনো কিছু আমি পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে জানতে চাইলে আপনি আমাদের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করেন। লিখিত তথ্য চাইলে বিস্তারিত পেতে পারেন।’

অভিজ্ঞ ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীদের পেছনে ফেলে প্রকল্প পরিচালক হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রণালয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এসব বিষয় তো আমার না। কারণ, আমি আমার নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করি না। আপনি আমাদের এমডি স্যার অথবা জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করেন।’

বিতর্কিত প্রকল্প পরিচালক ও প্রশ্নবিদ্ধ টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে দুইদিন যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা কেউই কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। এমন কী তাদের হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে বার্তা পাঠানো হলেও তারা কোনো উত্তর দেননি।

এখানে মোস্তাফিজুরের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি সামনে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার এক কর্মকর্তা যিনি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সাবেক ছাত্র ছিলেন তিনি নিশ্চিত করেছেন, কুয়েটে পড়ার সময় ছাত্রদলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। সে কারণে তার প্রকল্প পরিচালক হওয়া নিয়ে ওয়াসার বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। পরিষদের নেতারা আশা করছেন, ছাত্রদলের এই নেতার প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।