বিরহের সুরে ভাঙল ছেঁউড়িয়ার ‘সাধুর হাট’

  • এস এম জামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুষ্টিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বিরহের সুরে ভাঙল ছেঁউড়িয়ার ‘সাধুর হাট’

বিরহের সুরে ভাঙল ছেঁউড়িয়ার ‘সাধুর হাট’

ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি থেকে: বিরহের সুরে ভাঙল কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে বাউল সাধুদের মিলনমেলা ‘সাধুর হাট’। দোল পূর্ণিমায় সাধক ফকির লালন সাঁইজির জীবদ্দশায় রীতিনীতি অনুসারে চলে আসা এ স্মরণোৎসবে সারাদেশ থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল সাধুরা ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে ছুটে আসেন। দোল উৎসবে প্রতিবছর লাখো মানুষের ঢল নামে। তবে এবার রমজানের কারণে তিনদিনের আয়োজন সংক্ষিপ্ত করে কেবল একদিনেই সম্পন্ন করেছে লালন একাডেমি।

একাডেমির নিচে ছোট ছোট আসনে আসন গেড়ে বসেন আগত বাউল সাধুরা। সেসব আসর থেকে ভেসে আসছিল আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়, তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে….‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/....দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার’সহ লালনের অমীয় বাণী।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৪ মার্চ) বিকেলে লালন একাডেমির অডিটোরিয়ামে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি।

রোববার বিকেল থেকে শুরু হওয়া সাধু সংঘ শেষ হয়েছে সোমবার (২৫ মার্চ) দুপুরে। সাঁইজির প্রাণের টানে এই ধামে কেবল সাধু-গুরু বাউলদেরই দেখা মিলেছে। যেটি প্রতিবছর লাখোলাখো সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড়ই বেশি দেখা যেত।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছর দুপুরে সাধু-গুরু বাউলরা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করতেন। সেটি পরিবর্তন করে রোববার রাতে পুণ্যসেবার আয়োজন করে। রাত বারোটার সময় লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো: এহেতেশাম রেজা উপস্থিত থেকে পুণ্যসেবার আনুষ্ঠিকতার উদ্বোধন করেন। পুণ্যসেবার মধ্যে ছিল ভাত, মাছ, তিন পদের সবজি তরকারি ও দধি। প্রায় ৩ হাজার বাউল ভক্তদের একসঙ্গে বসে ত্রিব্যাঞ্জন দিয়ে “আল্লা আলেক” এর নাম করে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন।

বাউলরা বিশ্বাস করেন শুদ্ধ আত্মায় মুক্তি। মুক্তির আশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু সংঘে ছুটে আসা বাউলরা তাদের আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন।

প্রবীণ সাধু নহির শাহ বলেন, মানুষকে বিভক্তির বেড়াজালে না জড়িয়ে শুধু মানুষ হিসেবে দেখার কারণেই হয়তো তিনি মানুষকে ভজনা করতে বলেছেন। কারণ, তাতেই লুকায়িত রয়েছে শাশ্বত প্রেমের অমিয়ধারা, মানবমুক্তি যার ফল। বর্তমান যুগে তিনি মানুষকে দেখেছেন অবতার হিসেবে। বলেছেন, দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তা জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানব সেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে জ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেন সাঁইজি। 


নহির শাহ আরও বলেন, বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী রোববার সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে দোল পূর্ণিমা তিথি শুরু হয়েছে। এ তিথি শেষ হবে সোমবার দুপুর ১২টা ২৯ মিনিটে। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের অনুসারীদের কাছে এ তিথি এক উন্মাদনার নাম।

এর আগে একবার ঈদের কারণে একদিন দেরিতে উৎসব শুরু হয়েছিল, তবে এই প্রথম একদিনেই শেষ হলো বাউল আখড়ার দোল উৎসব।

অনেক লালনভক্ত উৎসব কাটছাঁটকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও তা মানতে পারছেন না অনেকে। আগের মতোই নিজস্ব রীতিতে দিনটি পালন করেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে আসা বাউল লিয়াকত আলী বলেন, “গুরু লালন না মুসলিম না হিন্দু, তিনি না বৌদ্ধ না খ্রিস্টান। লালনের ধর্ম মানব ধর্ম। আমরা যারা সাঁইজির অনুসারী তাদের ধর্মও মানব ধর্ম। আমরা তো অন্য কারও ধর্ম পালনে বাধা দেই না। তাহলে আমাদের ধর্মে কেন বাধা আসছে।”

লালন গবেষক ফকির হৃদয় সাঁই জানান, সাঁইজির ধামে বছরে দুটি অনুষ্ঠানে নয়, পার্থিব জীবনে এই মর্মবাণী উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে। আয়োজনে যোগ দেয়ার জন্য বাউলদের কোনো চিঠি দেয়া হয় না, জানানো হয় না নিমন্ত্রণ। তারপরও এক অদৃশ্য সূতোর টানে এরা দলে দলে ছুটে আসেন এ বাউল ধামে। প্রাপ্তি যাই হোক না কেন নিজেকে শুধরিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করায় তাদের মূল উদ্দেশ্য। তবে অনেকে আবার লালনের মূল আদর্শের তত্ত্ব মেনে বাউল ভক্তদের আনুষ্ঠানিকতা পালনের আহ্বান জানান।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বাউলভক্তরা জানান, সাঁইয়ের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তার ভক্ত আর শিষ্যদের নিয়ে দোল উৎসব করতেন। সেই নিয়ম মেনেই বাউলরা ভাটায় আসেন, উজানে ফিরে যান যে যার আপন নিবাসে। প্রকৃত বাউলরা সরকারি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখেন না। লালন আখড়ার আশপাশে ও একাডেমির নিচে যারা আসন গাড়েন তারা সাঁইকে ভক্তি আর আরাধনায় নিমগ্ন থাকেন। কখনো স্থান ত্যাগ করেন না।

দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহের বাউল জিল্লুর রহমান বলেন, “সরকার বা জেলা প্রশাসন কী অনুষ্ঠান করল বা করল না, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আখড়া বাড়িতে এসেছি, আমাদের রীতি নীতি পালন করে তবেই বাড়ি ফিরব।”

মরমি সাধক ফকির লালন সাঁই জীবদ্দশায় শিষ্যদের নিয়ে দোল পূর্ণিমায় কালীগঙ্গা নদীর তীরে সারা রাত তত্ত্বকথা আলোচনা ও গান বাজনা করতেন। বাংলা ১২৯৭ সনে তার মৃত্যুর পর ভক্ত-শিষ্যরা এ বিশেষ দিনটি নিজস্ব রীতিতে পালন করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দোল পূর্ণিমা তিথিতে আখড়া বাড়িতে ৩ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মাঝে কিছুদিন উৎসবের কলেবর বাড়িয়ে ৫ দিন করা হলেও পরে আবার তা ৩ দিনে নামিয়ে আনা হয়।

এ বিষয়ে লালন একাডেমির সদস্য সেলিম হক বলেন, “রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে উৎসব সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবীণ ও নেতৃস্থানীয় বাউলদেরও মতামত নেওয়া হয়েছে। যত দূর জানি এতে কারও দ্বিমত বা ক্ষোভ নেই।”