গাইবান্ধায় বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করেন সুজন প্রসাদ

  • মাসুম বিল্লাহ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

গাইবান্ধার সনাতন ধর্মের এক হোটেল ব্যবসায়ী সুজন প্রসাদ। চলমান পবিত্র রমজানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত রোজাদারদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করে থাকেন তিনি। যেখানে প্রতিদিন রিকশাচালক, ভ্যান চালক, ঠেলা ওয়ালা, ফুটপাতের দোকানী, পথচারী, স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী এবং দূর দূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় অর্ধশত মানুষ ইফতারে অংশ নেয়।

চলমান রমজানে এমন মহানুভবতা দেখিয়ে যাচ্ছেন গাইবান্ধা জেলা শহরের হকার্স মার্কেটের বাঙলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক সুজন প্রসাদ। রোজাদার ও স্থানীয়রা বলছেন, হিন্দু ধর্মের লোক হয়েও মুসলিম রোজাদারদের জন্যসুজন প্রসাদের বিনা মূল্যের এই ইফতার আয়োজন যেন এ শহরে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিজ্ঞাপন

মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রথম রমজান থেকে রোজাদারদের জন্য ইফতারের এমন আয়োজন করছেন বলে জানান সুজন প্রসাদ। সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ মহতী কাজটি চালিয়ে যেতে যান তিনি।

গাইবান্ধা জেলা শহরের রেলগেটের দিক থেকে হকার্স মার্কেটের প্রথম গলিতেই সুজন প্রসাদের এই "বাঙলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট"।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৫ মার্চ) পড়ন্ত বিকেলে সরেজমিনে হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, মাগরিবের আজানের আগেই টেবিলের ওপরে প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অন্তত ১৩ ধরনের থালা ভর্তি ইফতার। ইফতারের ওইসব থালায় রয়েছে, ছোলা বুট, বুনদিয়া, পেঁয়াজু, বেগুনের চপ, আলু মিশ্রিত ডিমের চপ, ঝুড়ি (চিনি ময়দায় তৈরি এক ধরনের খাবার) ও জিলাপি। এসবেই শেষ নয়- পুষ্টির চাহিদা জোগান দিতে ইফতারির প্লেটে যোগ করা হয়েছে, খেজুর, গাজর-শসা, কলা, তরমুজ, ও বেলের শরবত। এছাড়া একই প্লেটে রয়েছে বিরিয়ানিও।

সন্ধ্যার আজানের ঠিক আগ মুহূর্তে দেখা যায়, একে একে বাঙলা হোটেলে ইফতার করতে আসছেন রোজাদার ব্যক্তিরা। ঠিক এমন সময় কর্ম ব্যস্ততাও বাড়ে হোটেলের মালিক সুজন প্রসাদসহ হোটেলের কর্মচারীদের। তবে, হোটেলের কর্মচারীরা কেবল পানি দেওয়া এবং অন্যান্য কাজ করলেও ইফতার পরিবেশন করেন সুজন প্রসাদ নিজ হাতে। ইফতারের সময় হতেই রোজাদারে পরিপূর্ণ হয় হোটেলটি।

এসময় হোটেলের মালিক সুজন প্রসাদসহ হোটেল সংশ্লিষ্টরা মালিকের মতো কিংবা ব্যবসায়ীর মতো না থেকে রোজাদারদের অতিথি আপ্যায়নের মতো করে সমাদার করতে থাকেন। 

দেখা যায়, ‘বিনামূল্যে ইফতার’ প্লেটে সাজানো ১৩ ধরনের ইফতার দেখে আজানা নিম্ন আয়ের বেশ কয়েক রোজাদার হোটেলে ঢুকতে গরিমসি করছেন। তাদের ধারণা, আকর্ষণীয় এসব ইফতার সামগ্রীর দাম নিশ্চিত আকাশ চড়া। এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়া মানুষের আচরণ বুঝতে পেরে তাদেরকে অতি বিনয়ের সাথে হোটেলের ভেতরে ডেকে নেন সুজন প্রসাদ। পরে মনের আনন্দেই তৃপ্তির ইফতার করেন ওইসব রোজাদাররাও।

এছাড়া এই হোটেলে হঠাৎ এবং প্রথমদিন ইফতারে আসা তিনজন ব্যাংক চাকরীজী ইফতার শেষে দাম জানতে চেয়ে ইফতারির বিল দেওয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়। কিন্তু সুজন প্রসাদ তাদের হাসি মুখে "এখানে ইফতারের কোনো টাকা নেওয়া হয়না জানিয়ে প্রতিদিন এখানে এসে ইফতার করবেন" বলে দাওয়াত দেন। যদি পারেন দুই একজনকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন-বলেন সুজন প্রসাদ। ইফতার শেষে সুজন প্রসাদকে কৃতজ্ঞতা জানায় এসব রোজাদাররাও।

এদিন ইফতারে অংশ নেওয়া বোয়ালী ইউনিয়নের সাবুতখালীর ভ্যান চালক আব্দুস সবুর বলেন, বেশ কয়েকদিন থেকে দাদার হোটেলে বিনে টাকায় ইফতার করি, পেট ভরে গেছে। ইফতারে যত কিছু থাকে আমাদের মতো গরীবের এতকিছু জোগার করা সম্ভব নয়। এসময় সুজন প্রসাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন এই ভ্যানচালক।


গোবিন্দপুর এলাকার ওই বাজারের পান ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, এখানে প্রতিদিন পথচারী, রিকশাচালক, অটোরিকশা চালক, ভ্যানচালক, হোটেলের কাছাকাছি ফুটপাতের দোকানদার এবং এই বাজারের কিছু ব্যবসায়ী নিয়মিত ইফতারে অংশ নেয়। আমি প্রতিদিন এখানে ইফতার করে থাকি। বিনে টাকায় এমন মানের ইফতার আয়োজন জেলার আর কোথাও করায় বলে আমার জানা নেই।

প্রেসক্লাব গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক জাভেদ হোসেন বলেন, "সুজন প্রসাদ একজন হিন্দু ধর্মের লোক। তার এমন ইফতার আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমার মনে হয় সুজন প্রসাদ একেবারেই অন্তর থেকে মানসম্মত এবং রুচি সম্মত এইসব ইফতার আয়োজন করে থাকেন। 

গাইবান্ধার সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু মোবাইল ফোনে বার্তা২৪কে বলেন, হিন্দু ধর্মীয় লোক হয়েও মুসলিম রোজাদারদের জন্য সুজন প্রসাদের মহতী এই ইফতার আয়োজন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সুজন প্রসাদের এমন আয়োজনই প্রমাণ করে বাংলাদেশ অসম্প্রদায়িক দেশ। মুসলমানের জন্য সুজনের ইফতার আয়োজনের এই বার্তা দেশে অসাম্প্রদায়িকতায় আরো ভূমিকা রাখবে। 

জানতে চাইলে ব্যবসায়ী সুজন প্রসাদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি যে ধর্মই পালন করিনা কেন-দিন শেষে ‘আমি একজন মানুষ’। তাই মানুষ হিসেবে এ দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমি রোজাদারদের জন্য এই ইফতারের আয়োজন করছি। আমি আমার সাধ্যনুযায়ী পরিমাণমত এবং মানসম্মত ইফতার পরিবেশনের চেষ্টা করে থাকি।

এ সময় তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশ একটি অসম্প্রতায়িক দেশ। সবার ওপরে আমরা মানুষ। একে অপরের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার রয়েছে। এসময় সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিবছর এ মহতী কাজটি চালিয়ে যেতে প্রত্যাশা রাখেন সুজন প্রসাদ।