গাইবান্ধা জেলা কারাগারের ভিতরে কারারক্ষীর সঙ্গে এক নারী কয়েদির ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড দেখে ফেলায়’ অপর এক নারী হাজতিকে বিবস্ত্র করে এবং হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনা গোপন রাখতে প্রাণনাশসহ দেওয়া হচ্ছে সম্ভ্রমহানির হুমকিও। অভিযোগের পর ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।
ভুক্তভোগী ওই নারী হাজতি (৩৪) দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামের। তিনি প্রায় ৫ বছর ধরে মাদক মামলায় গাইবান্ধা হাজতে রয়েছেন।
গাইবান্ধা জেলা কারাগারের ভিতরে লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অসুস্থ ওই নারী হাজতির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা, জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী হাজতির মা। সেই অভিযোগের একটি কপি এসেছে বার্তা২৪.কমের হাতে।
ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন গাইবান্ধা কারাগারের প্রধান কারারক্ষী (সুবেদার) আশরাফুল ইসলাম ও মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন। এছাড়া অন্যান্য অভিযুক্তরা হলেন নারী কয়েদী রেহেনা ও আলেফা। কারারক্ষী তহমিনা, সাবানা, সিআইডি আনিছ ও হাবিলদার মোস্তফা।
গত ১৬ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, হাজতি (৩৪) একটি মামলায় প্রায় ৫ বছর যাবত গাইবান্ধা জেলা কারাগারে রয়েছেন। কারাগারে অবস্থানকালে কিছুদিন আগে গাইবান্ধা জেলা কারাগারে কর্মরত সুবেদার আশরাফুল ইসলাম এবং অপর এক মহিলা কয়েদির মধ্যে ‘অবৈধ কর্মকাণ্ড দেখে ফেলেন’। এতেই সুবেদার আশরাফুল ও ওই মহিলা কয়েদি ভুক্তভোগীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তারা ঘটনার বিষয়ে কাউকে বললে কারাগারের ভিতরেই তাকে খুন-জখমে হত্যা করে আত্মহত্যায় মৃত্যু কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে মর্মে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। ভুক্তভোগী হাজতি বারবার তাদেরকে (সুবেদার আশরাফুল ও ওই নারী কয়েদি) ঘটনার বিষয়ে কাউকে কিছু বলবে না মর্মে জানানোর পরেও সুবেদার আশরাফুল ও মহিলা কয়েদি কারাগারের ভিতরে ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া সুবেদার আশরাফুল ভুক্তভোগীকে জিম্মি করতে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে কু-প্রস্তাব দিয়ে উত্যক্তসহ হাত এবং পরনের কাপড় ধরে টানা-হেঁচড়াসহ একাধিকবার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। পরে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দিয়েও সুবেদার আশরাফুলের কামনা চরিতার্থে ব্যর্থ হয়ে তার সহযোগীরা ভুক্তভোগী হাজতির স্বামীকে গাইবান্ধা কারাগারে ডেকে নেয়। অভিযুক্তরা ভুক্তভোগী হাজতির বিরুদ্ধে মিথ্যা ও আপত্তিকর তথ্য দিয়ে তার সংসার ভেঙে দেয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
ভুক্তভোগী হাজতি এসব ঘটনা জেল সুপারকে অবগত করবে মর্মে জানালে, সুবেদার আশরাফুল দাবি করেন, জেলার সাহেব তার লোক, তিনি (সুবেদার) নিজের টাকা খরচ করে জেলারকে এই কারাগারে বদলি করে এনেছেন। জেলার তার (সুবেদারের) কোন বিচার করতে পারবেন না দাবি করে ভয়-ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন করেন। এসবের এক পর্যায়ে চলতি বছরের গত ২০ মার্চ দুপুরে সুবেদার আশরাফুলের নেতৃত্বে মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন, রেহেনা, আলেফা এবং কারারক্ষী তহমিনা ও সাবানা পরিকল্পিতভাবে জেলা কারাগারের মহিলা ইউনিটের ভিতরের বারান্দায় লাঠি দিয়ে সীমার মাথায়, কোমরে বুকে, পিঠে, দুইপায়ের হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে এলোপাথাড়ি মারপিট করতে থাকে। মহিলা কয়েদি মেঘলা ভুক্তভোগীর ডানহাতে কামড় দিয়ে মাংস ছিঁড়ে নেন বলে অভিযোগ করা হয়।
শুধু তাই নয়, সুবেদার আশরাফুল, সিআইডি আনিছ ও হাবিলদার মোস্তফাগং কারাগারের মহিলা ইউনিটের ভিতরে প্রবেশ করে ভুক্তভোগী হাজতিকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে মহিলা ইউনিটের বারান্দা হতে সেলের ভিতরে নিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ও দুই পা রশি দিয়ে বেঁধে বিবস্ত্র করে লাঠি দিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান (দুই উরু), পায়ের পাতায় পেটাতে থাকে। এ সময় নির্যাতনকারীরা এসবের কোনও ঘটনা কারাগারের বাহিরে প্রকাশ হলে ভুক্তভোগী হাজতিকে মারপিটে হত্যা করে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলে চালাবে মর্মে আবারও হুমকি দেয়।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, নির্যাতিতা হাজতির মা একাধিকবার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গাইবান্ধা কারাগারে গেলেও মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে ভুক্তভোগী হাজতি গাইবান্ধা আদালতে হাজিরার তারিখে আদালতে গেলে মেয়ের সাক্ষাৎ পান মা। ওইদিন ভুক্তভোগী হাজতি মায়ের কাছে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং শরীরের বিভিন্নস্থানে জখমের চিহ্ন দেখান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের অভিযুক্ত প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিষয়টির সাথে আমি জড়িত না। আমার নামটা কেন আসতেছে বিষয়টি আমার জানা নেই। ঘটনাটি একমাস আগের। তিনি দাবি করেন, ঘটনাটি এখানকার আরেক প্রধান কারারক্ষী মোস্তফার ডিউটির সময়ের। কিন্তু আমার নাম কেন হচ্ছে আমি বিষয়টি জানি না।
আগের প্রধান কারারক্ষী মোস্তফার নাম বর্তমান কারারক্ষী উল্লেখ করলেও তার বক্তব্য নিতে পারেনি বার্তা২৪.কম।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অপর অভিযুক্ত মহিলা কারারক্ষী তহমিনা আক্তার মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। সেদিন যা ঘটেছিল তার বিপরীত ঘটনা তুলে ধরে অভিযোগ করা হয়েছে। এসময় তিনি কারাগারের আরেফিন নামের এক নারী কারারক্ষী ও তার স্বামীর মদদে এই বন্দি এসব মিথ্যা অভিযোগ করেছেন বলে দাবি করেন।
এছাড়া এই বন্দি একাধিক মামলার আসামি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসনের ওপর হাত তোলার একাধিক অভিযোগ ও মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঘটনার দিনও সাবানা নামের এক নারী কারারক্ষীর গায়ে হাত তুলেছিলেন বলেও দাবি করেন কারারক্ষী তহমিনা।
এসব ব্যাপারে গাইবান্ধা কারাগারের জেল সুপার জাভেদ মেহেদী বার্তা২৪.কমকে বলেন, গতকাল এডিসি তদন্তে এসেছিলেন। ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারাগারের ভিতরের ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটি ব্যাপার তৈরি হয়েছে। যা ফোনে বলা সম্ভব নয়। তবে ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি) মো. মশিউর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, অভিযোগ পেয়ে গতকাল বিষয়টি তদন্ত করেছি। খুব দ্রুত জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেব। এর পরেই জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন জেলা প্রশাসন।