সুন্দরবনের পাশে কালাবগীর মানুষের ঋণের জালের ফাঁস কতটা জটিল?

  • সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঋণের টাকায় ঘর বানাতে হয়, কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দাদের/ছবি: নূর এ আলম

ঋণের টাকায় ঘর বানাতে হয়, কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দাদের/ছবি: নূর এ আলম

ন্যূনতম স্বস্তিদায়ক জীবনযাপন বলতে যা বোঝায় তার সাথে কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার মানুষের কোন পরিচয় নেই। শিবসা ও সুতারখালি নদীর মাঝে পলিমাটি দিয়ে গড়ে ওঠা কালাবগী গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে বাস করে প্রায় ৩০০টি পরিবার যারা কখনই মজবুত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারেনি।

নদীর পাশে এক বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতে, বাঁশের উঁচু মাচায় তাদের ঘরবাড়ি এমন ভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে যেন জোড়ালো হাওয়ায় পালকের মতো উড়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতি বছর, শিবসা নদীর প্রবল জোয়ারের ঢেউ নদী ভাঙনের মাধ্যমে এই পাড়ার ভূগোলই প্রায় পরিবর্তন করে ফেলে। এর ফলে প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা তাদের ঘরবাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

তাদের জীবনকে দুর্গত করতে প্রতিবছর সাইক্লোন আর জলোচ্ছাস নিয়ম করে তাদের ঘরবাড়ি ও জীবিকা ধ্বংস করে যায়।

ঝুলন্ত পাড়ার দরিদ্র মৎস্যজীবীদের কুঁড়েঘর/ছবি: নূর এ আলম


দরিদ্র মৎস্যজীবীদের তাদের কুঁড়েঘরগুলি পুনর্নির্মাণ করতে হয় ঋণের টাকা দিয়ে। তারা স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তৈরি করে। এছাড়া আর কী বা করতে পারে তারা?  বৃদ্ধ বাবা-মা, শিশু এবং স্ত্রীর জন্য তো মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রয়োজন।

পঞ্চাশ বছর বয়সী মৎস্যজীবী গোলজার সানা বার্তা২৪ কে বলেন যে যতবার তার পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত হয়, ততবার তাকে তার কুঁড়েঘর পুনর্নির্মাণের জন্য একটি ছোট্ট জমি ভাড়া নিতে হয়  জমির মালিককে এককালীন অর্থ দেয়ার মাধ্যমে।

“আমরা যদি আশেপাশের এলাকা থেকে বাঁশ ও গোলপাতার মতো নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহও করি, একটি ঘর পুনরায় তৈরিতে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা লাগে। সমস্ত অর্থই ঋণ হিসেবে জোগাড় করতে হয়,” গোলজার বললেন।

কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার কোনো বাসিন্দাই তাদের বসবাসের বাসস্থানের জন্য জমির মালিক হতে পারেনা। তারা যে ছোট্ট জমিতে ঘর গড়ে বসবাস করে তার জন্য প্রতি বছর কিছু ধনী জমির মালিককে ভাড়া প্রদান করে। সেই জমির মালিকরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ স্থানে যেমন খুলনা শহরে বাস করে। কোন কোন জমির মালিক অবশ্য মহাজন বা ঋণদাতা হয়ে আসেন, যাদের থেকে দরিদ্র মৎস্যজীবীরা উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে তাদের জীবিকা চালায়।

গোলজারের এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে, যারা দাকোপ এলাকায় স্কুল বা কলেজে পড়ছে। তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানো ছাড়াও তাকে তার সন্তানের মাসিক শিক্ষার খরচ দিতে হয় করতে হয় যা জনপ্রতি কমপক্ষে ৩,০০০ টাকা।

আপনি কীভাবে অর্থ জোগাড় করেন? আমরা তাকে প্রশ্ন করি। গোলজার উত্তরে বলেন, “বর্তমানে, আমি ৯০,০০০ টাকা ঋণী। গত বছর, আমার ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০,০০০ টাকা। আমি ২০,০০০ টাকা পরিশোধ করেছি। ৩০,০০০ টাকার দায় ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়  রিমাল (২৬ জুন) আমার ঘর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। একারণে আমি কয়েক সপ্তাহ আগে ৬০,০০০ টাকা ঋণ  করেছি,”।

ছবি: নূর এ আলম

খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায় বাপদাদার বসতভিটা নদীভাঙনে তলিয়ে যাওয়ায় চল্লিশ বছর আগে মাজেদ গাজী কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ায় চলে আসেন। সেই সময়ে, ঝুলন্ত পাড়ায় মাত্র ৩০টি পরিবার ছিল।

বর্তমানে ৫৮ বছর বয়সী মাজেদ কালাবগীতে তার জীবনে অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখেছেন। এ বয়সেও তিনি কিছু ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা যা কালাবগী এলাকার দক্ষিণ প্রান্তের তিন-চতুর্থাংশ ভেঙে নদীতে মিশিয়ে দিয়েছিল। আইলায় তার পরিবার এবং অনেক প্রতিবেশী বাস্তুচ্যুত হয়।

মাজেদ হতাশা নিয়ে বলেন, “আমাদের ঘরদোড় বছরে দুই থেকে তিনবার সরাতে হয় নদীভাঙন বা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। এটি একটি নিয়মিত ঘটনা। প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের উপর নতুন করে অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। আমরা এর থেকে বের হতে পারি না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক টাকাও সঞ্চয় করতে পারি না।”

বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার বাসিন্দারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মৎস্যজীবী হিসেবে কাজ করছে।

ষাট বছর বয়সী শহিদুল গাজীর দুই ছেলেও একই পথ অনুসরণ করেছে। তবে, তার বড় ছেলে আবদুল গাজী নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে।

এখন, শাহিদুল এবং তার স্ত্রী জায়েদা বেগম সম্পূর্ণরূপে তার ছোট ছেলে আলমগীর গাজীর আয়ের উপর নির্ভরশীল। দুই বছর আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে শহিদুর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

“খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে আমার ছেলের (আলমগীরের) স্বল্প আয়ে পরিবারের খরচ মেটানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে,” জায়েদা বলেন। সুন্দরবনে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে তার ছেলে বছরে অন্তত পাঁচ মাস আয় করতে পারে না ।

যখন সুন্দরবনে মাছ ধরার পাশ দেওয়া হয়, তখন আলমগীর দিনে ৫০০-১,০০০ টাকা আয় করতে পারে। তবে, আয়ের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়।

“একারণে টিকে থাকতে আমাদের সারা বছর ঋণ নিতে হয়,” জায়েদা বললেন। বর্তমানে, পরিবারটির ৫০,০০০ টাকা ঋণ রয়েছে, যার মধ্যে গত বছরের দায় ৩০,০০০ টাকা অন্তর্ভুক্ত।

যখন জায়েদা তার ঝুলন্ত কুঁড়েঘরে কথা বলছিলেন, তখন নির্বাক শহিদুল তার স্ত্রীর দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি নিমাই কুমার রায় বার্তা২৪ কে বলেন যে এই ঝুলন্ত পাড়া গ্রামের মানুষরা নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে।

“এখানে বিকল্প আয়ের কোন উপায় নেই যে তারা দুর্যোগে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে। তাদের ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়ারও কোন উপায় নেই। পর্যাপ্ত এবং ধারাবাহিক সরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের এই অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব,” নিমাই বলেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খান মেহেদি হাসান দেখেছেন যে কালাবগী ঝুলন্ত পাড়ার মৎস্যজীবীদের জন্য অর্থের প্রবাহ প্রয়োজন, বিশেষ করে মাছ শিকারের এবং নিয়মিত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্য। এই অর্থের জন্যই তারা স্থানীয় মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকেন।

“যদি তাদেরকে ঋণের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করতে হয় তাহলে সরকারকে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে সনাক্ত করে তাদের জীবিকা যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকে তার জন্য অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে,” অধ্যাপক খান উপসংহারে বলেন।