ফটোগ্রাফারের ছদ্মবেশে শিশুদের টার্গেট করতেন টিপু কিবরিয়া
![ছবি: বার্তা ২৪](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2024/Jun/30/1719723246539.jpg)
ছবি: বার্তা ২৪
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে ১৯৯১ সালে একটি মাসিক কিশোর পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া। দক্ষ ফটোগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া টিপু কিবরিয়া ৯০ দশকের আলোচিত ওয়েস্টার্ন সিরিজ ও তিন গোয়েন্দা বইয়ের জনকও। তার হাতের তোলা ছবি হয়ে উঠতো জীবন্ত। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে টিপু কিবরিয়া একজন ছদ্মবেশী শিশুদের ‘নগ্ন ছবি’র কারিগর।
শিশু-কিশোরদের জন্য দুর্দান্ত কল্পকাহিনী লেখা টিপু কিবরিয়া শহরজুড়ে ক্যামেরা হাতে ফটোগ্রাফার পরিচয়ে ঘুরে বেড়াতেন। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে ঘুরে অসহায় ও ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি তুলতেন। ছবি তোলার আড়ালে আসলে নগ্ন ছবির মডেল খুঁজতেন তিনি।
সুবিধামতো কোনো ছেলে শিশুকে পেয়ে গেলেই ক্যামেরা হাতে তার আসল কাজ সেরে ফেলতেন। আরও ভালোভাবে কাউকে পেলে নিয়ে আসতেন খিলগাঁওয়ের স্টুডিওতে। সেখানেও নানান ভঙ্গিতে বিশেষ দৃশ্যের ছবি তুলতেন তিনি। বিনিময়ে শিশুদের এক বেলা খাবার বা অল্প কিছু টাকা দিয়ে দিতেন।
![](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&quality=100&path=uploads/news/2024/Jun/30/1719735572057.jpg)
চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁওয়ে নিজের স্টুডিওতে এক শিশুর নগ্ন ছবি তোলার সময়ে হাতেনাতে সহযোগীসহ আটক হন টিপু কিবরিয়া।
এর আগে ২০১৪ সালের ৯ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একই অপরাধে তাকে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে মুক্তি পেয়ে যান টিপু। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটিও তদন্ত করছে সিটিটিসি’র স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ অ্যান্টি-ইলিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম।
সিটিটিসির অ্যান্টি-ইলিগ্যাল আর্মস সূত্রে জানা গেছে, সিআইডির দায়ের করা মামলায় দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০২২ সালে খালাস পান টিপু কিবরিয়া। কারাগার থেকে বের হয়ে আরও একটি কিশোর উপন্যাস লেখেন। এরপর আবারও ফিরে যান তার পুরনো পেশায়। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন কামরুল ইসলাম।
২০২২ সালে মুক্তি পাওয়ার পার এ বছর গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত শতাধিক শিশুদের ১০ হাজারের বেশি নগ্ন ছবি তুলেছেন টিপু কিবরিয়া। আর এই সব ছবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছে বিক্রি করতেন তিনি।
সিআইডির মামলার নথি বলছে, ২০০৫ সাল থেকে সিআইডি ইন্টারপোলের মাধ্যমে তথ্য পাচ্ছিল একটি চক্র পর্নগ্রাফি তৈরি করে দেশের বাইরে বিক্রি করছে। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে জার্মান পুলিশ টিপু কিবরিয়ার কাছ থেকে পর্নগ্রাফি ছবির ক্রেতা হিসেবে মার্ক নামের এক নাগরিককে শনাক্ত করে। মার্ক জার্মানির একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুতের পাশাপাশি জেল যেতে হয়।
এরই সূত্র ধরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে শনাক্ত করা হয় টিপু কিবরিয়াকে। গ্রেফতার হওয়ার পর দীর্ঘ ৯ বছর কারাগারেই কাটে কিবরিয়ার। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তদন্ত ও যথাযথ সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপন করতে না পারায় কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও জড়িয়ে পড়েন একই কাজে।
টিপু কিবরিয়ার মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির সিটিটিসি’র স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ অ্যান্টি-ইলিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিমের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মিশুক চাকমা বার্তা২৪.কমকে বলেন, শিশুদের নগ্ন ছবি ও ভিডিওর বিষয়টি অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল পুলিশের নজরে এলে তারা বাংলাদেশ পুলিশকে চিঠি দিয়ে জানায়। সেই চিঠির সূত্র ধরে আমরা রাজধানীর খিলগাঁও থেকে টিপু কিবরিয়া ও তার সহযোগী কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করি। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, তার বাসা ও স্টুডিও থেকে জব্দ হওয়া কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ডিভাইস ফরেনসিকের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট এখনো আসেনি। এছাড়া তার কম্পিউটার থেকে পাওয়া ভুক্তভোগী শিশুদের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছি। সবাই পথশিশু হওয়ায় তাদের শনাক্ত করা কঠিন। তবে আমরা লেগে আছি।
মিশুক চাকমা আরও বলেন, আমাদের অভিযানের সময় এক ভুক্তভোগী শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাকে টিপু কিবরিয়া ছবি তোলার জন্য এনেছিল। সেও একজন পথশিশু। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি ছাড়ে সে। শিশুটি উদ্ধার হওয়ার পর তার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিয়েছি আমরা।
অতীতে একই ধরনের অপরাধের মামলায় কারাগারে গেলেও আদালত খাসাস দিয়েছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিসি মিশুক চাকমা বলেন, সেই সময়ে তদন্তকারীরা অনেক তথ্য-প্রমাণ হাজির করলেও আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। মামলায় আসামিকে খালাস দেওয়ার পাশাপাশি বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল। আমরা সেই সব পর্যবেক্ষণ মাথায় রেখে কাজ করছি।
এদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টিপু কিবরিয়া একজন লেখক পরিচয়ের মানুষ হলেও তার ভেতরে সমকামিতা ও বিকৃত মানসিকতা ছিল। শুরুর দিকে তার তোলা কিছু নগ্ন ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করেন টিপু কিবরিয়া। সেখান থেকেই জার্মান নাগরিক মার্কসহ অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এভাবে ধীরে ধীরে শিশুদের নগ্ন ছবির ক্রেতা হয়ে ওঠেন বিদেশি বহু নাগরিক। টিপু শুধুমাত্র ছেলে শিশুদের আপত্তিকর ছবি তুলতেন।
দক্ষ ফটোগ্রাফার হওয়ায় তার এই সব ছবি চড়া দামে বিক্রি হতো অনলাইনের অন্ধকারের হাটে। এভাবে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করেছেন টিপু কিবরিয়া।
দুই সন্তানের জনক টিপু কিবরিয়াকে জামিনে মুক্ত করতে তার পরিবার নানাভাবে চেষ্টা করছে। তবে শিশুদের নগ্ন ছবি তোলার বিষয়ে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।