কার কাছে বলি, জীবন-জীবন!

  • কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ শিরোনামের একটা কাব্য লিখেছেন কবি হেলাল হাফিজ। তার এই কবিতার বইয়ের কালোত্তীর্ণ কবিতার নাম ‘অশ্লীল সভ্যতা’। দুই শব্দের শিরোনাম কবিতার, আর পূর্ণাঙ্গ কবিতা মাত্র দুই লাইনের; ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝ না!’ কী বিপুল শক্তির আধার লাইন দুটো। কী বিপুল শক্তির আধার কবিতার শিরোনাম। মানুষ আর মানুষের জীবনকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভাবার যে সভ্যতা সেটা অশ্লীল না হয়ে পারে!

কবিতাটি আশির দশকের। তবু প্রাসঙ্গিক সব সময়। নানা ভাবে লাইন দুটো আলোচনায় আসে। বেশি করে আসে তখন, যখন জীব আর জড়ের ভেদ নির্ণয়ের চেষ্টা আসে সামনে। যখন মানুষকে গৌণ রেখে অন্যকিছু মুখ্য দেখানোর চেষ্টা চলে তখন। এবারের কোটা আন্দোলনের সময় কবিতাটি ফের নাড়া দিয়েছে। দাবি আদায়ের দাবিতে যারা মাঠে নামে, তাদের দাবি যৌক্তিক হতে পারে, অযৌক্তিক হতে পারে, তাদের দাবি মানা-না মানা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিষয় হতে পারে; কিন্তু শক্তি প্রয়োগ? না, অবশ্যই না! বিষয়টি অমানবিক, অশ্লীল বটে!

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় বিচ্ছিন্ন মারামারির হলেও ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় সহিংসতার। এই সহিংসতায় অন্ধকারের আততায়ীদের অনুপ্রবেশে আন্দোলন ছিনতাই হয়েছে, নাশকতা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে, মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, স্বাভাবিক নাগরিক জীবন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল, রাষ্ট্র অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল, সরকার বেকায়দায় পড়েছিল, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ছিল না; সব সত্য। একটিও অস্বীকারের উপায় নাই। এখানে কে দায়ী, কারা দায়ী, কেন দায়ী, কীভাবে দায়ী— এ আলোচনা হচ্ছে কই? আলোচনা শুরুর চেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। এরআগে বিভাজনের কবলে পড়ে নিজ নিজ অভিসন্ধি, বিশেষ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চলছে।

এই আন্দোলন এবং আন্দোলন পরবর্তী সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কত প্রাণের অপচয় হয়েছে, সে পরিসংখ্যান নাই। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কত পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে, কত পুলিশ হয়েছেন হতাহত। সরকার যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছে, সে কমিটি সহিংসতার প্রথম দিনের কেবল ৬ মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করবে, মন্তব্য করবে, নানা সুপারিশ দেবে। এরবাইরে যে অগণন মৃত্যু সে মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হবে না। বিচার হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না, কারণ সাধারণত এ ধরনের মৃত্যুর অপ্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি পেয়ে থাকে দায়ীরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই আশঙ্কা। তবে বিচার না হলেও যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হবে, এনিয়ে সন্দেহ নাই।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সঠিক হিসাব আছে। হিসাবে থাকা মানুষ বলে সহিংসতার কবলে পড়ে, সহিংসতায় অংশ নিয়ে তাদের কতজন হতাহত হলো সে হিসাব রাখবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাদের পরিবারের জন্যে থাকবে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। তাদের দায়িত্ব নেওয়ার কর্তৃপক্ষ আছে। কিন্তু অন্যদের...? তাদের যেমন হিসাব নাই, তেমনি দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নাইও। ফলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা তাদের জন্যে থাকবে না, এমনকি ন্যূনতম সহানুভূতিও জুটবে না কোন কর্তৃপক্ষ থেকে। বরং একেক মৃত্যু পরিবারের সদস্যদের ভোগান্তি বাড়াবে। বিভাজনের কবলে পড়ে নানা জঞ্জাল পোহাতে হবে অনেক পরিবারকে।

যে কোনো মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বিশাল সহিংসতায় যত লোকের প্রাণ গেছে তাদের কেউ কেউ সহিংসতার অংশ ছিলেন, কেউ কেউ কবলে পড়েছেন। এখানে দায় খোঁজার চাইতে মানুষের মৃত্যু হিসেবে আমাদের বিষয়টি দেখার সুযোগ ছিল, কিন্তু সে সুযোগ নেওয়া হচ্ছে আদৌ? এখানে কে সরকারবিরোধী, আর সরকারপক্ষীয়— এ বিভাজনের যে ভেদরেখা এঁকে দেওয়া সারা, তা শেষ পর্যন্ত ‘অশ্লীল সভ্যতা’র প্রতিরূপ। মানুষ না বুঝার কী বীভৎস চিত্র।

সহিংসতা ঠেকাতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার দেশে কারফিউ দিয়েছে। নাগরিক অধিকারকে সংকোচনের মাধ্যমে বৃহত্তর অধিকার সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে বলে দাবি। নিকষ আন্ধার শেষে ফুটে দিনের আলো ভেবেই নাগরিক অধিকার অগ্রাহ্যের বিষয়টি সহ্য করে যাচ্ছে দেশ।

আন্দোলন-পরবর্তী সহিংসতায় যত প্রাণের অপচয় হয়েছে, তারা ফিরবে না আর। আহত যারা তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি আমরা জানাতে পারি রাষ্ট্রের কাছে। তবে চিকিৎসাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। গণমাধ্যমের খবর, গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকেই চিকিৎসা শেষের আগেই হাসপাতাল ছাড়ছেন। এখন যখন সরকার আছে মামলা নিয়ে তখন অনেকের গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেই সহিংসতার অংশ, অনেকেই আবার স্রেফ ঘটনার আকস্মিকতায় আহত হয়েছেন— তারাও চিকিৎসা শেষ করতে পারবেন কিনা সে সন্দেহের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের সুযোগসন্ধানী চক্রও তৎপর হয়ে ওঠে। এখানে যে বাণিজ্যের যোগ অনেকটাই!

কোটা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না শেষ পর্যন্ত। দেশও ছিল না শেষের দিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যেমন মারধর করেছে, তেমনি মারও খেয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি দেশে চলছে কারফিউ। লাঠিচার্জ-গুলি-আগুন-কাঁদানে গ্যাস-পিপার স্প্রে সব ছিল। এসবে বিপন্ন ছিল মানুষ। এখন এমনও মৃত্যুর খবর আসছে যারা এই সংঘর্ষের কোন অংশ ছিল না, ছাদে-রাস্তায়-বারান্দায় গুলি খেয়েছে, মারা পড়েছে। যদিও সংখ্যার সঠিক তথ্য নেই, আগ্রহও নেই সরকারের, তবু এসব মৃত্যু অস্বীকার করা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন মাধ্যমে অন্তত দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর তথ্য জানানো হচ্ছে। এ সংখ্যা ঠিক কত তা কেউ জানে না। তবে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জানি, এই সহিংসতায় সরকারি স্থাপনার নানা ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার উচ্চ পদস্থদের নিয়ে ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শনে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের স্টেশন পরিদর্শন করে আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। তার সেই কান্না আমাদেরকেও ছুঁয়ে গেছে। তিনি দেশবাসীর কাছে এর বিচার চেয়েছেন।

ইট-পাথুরে-প্রযুক্তি ও নানা মাধ্যমের স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি সাধনে রাষ্ট্রের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরকার ও সরকারপ্রধান আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি দেখিয়ে আবেগাপ্লুত হচ্ছেন। এর আর্থিক মূল্যমান নির্ধারণ হবে। এটা রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হতেও যাচ্ছে। কিন্তু যে মানুষ মরল, যে মানুষদের মেরে ফেলা হলো, সে বিষয়ে কথা হচ্ছে সামান্যই। রাষ্ট্র যে পথে এগোচ্ছে তাতে সামনে চলে আসছে তুল্যমূল্য বিচারে অগ্রাধিকারের বিষয়। আমরা সরকারের অংশ নই বলে সরকারি স্থাপনা ও সম্পদকে জড় পদার্থ হিসেবে দেখতে আগ্রহ দেখাচ্ছি, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হলেও এটা পূরণীয় বলে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু প্রাণের অপচয়, সেটা পূরণ হবে না বলেই তো জানি।

সরকার প্রতিষ্ঠান বলে প্রাতিষ্ঠানিক দিক আর প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিতে আর্থিক মূল্যমান নির্ধারণে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে, কিন্তু আমরা মানুষ বলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি আমাদেরকে পীড়া দিলেও মানবিক দিক হিসেবে মানুষের জীবনের মূল্যটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি, এবং এটাই আলোচ্য বলেই মনে করছি। টাকা থাকলে মেট্রোরেল হবে, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা সংস্কার হবে, নির্মিত হবে, শত-হাজার সংখ্যক গাড়ি কেনা যাবে; কিন্তু টাকা থাকলেও মানুষের জন্যে এক ফোটা রক্তও তৈরি করা যাবে না; আর জীবন ফিরিয়ে দেওয়া, সে তো অসম্ভবই!