পাবনার ‘সাইকেল বাদশা’ যেন আরেক পলান সরকার

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, পাবনা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পেশায় তাঁত শ্রমিক হলেও কাজের ফাঁকে আশেপাশের গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণ করেন পাবনার সাইকেল বাদশা। দেন রোপণ ও পরিচর্যার পরামর্শও। এ যেন প্রায় শতবছর বয়সী নাটোরের সেই পলান সরকার। যিনি পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসতেন। তবে সাইকেল বাদশা দেন সবজি বীজ, পার্থক্য এটুকুই।

পাবনার বেড়া উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে জগন্নাথপুর গ্রাম। এই গ্রামের দরিদ্র তাঁত শ্রমিক বাদশা আলম (৪৫)। নামে যেমন বাদশা, মনেও তিনি বাদশা। সব সময় তার মনে উঁকি দেয় কি করে মানুষের ভালো করা যায়। এ জন্য তিনি ভাঙাচোরা একটি সাইকেল নিয়ে প্রায়ই বেড়িয়ে পড়েন বেড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণ করেন পাবনার সাইকেল বাদশা। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ও তার নিজের গলায় ঝোলানো থাকে বিভিন্ন সবজি-বীজ ভর্তি বোতল। বিনামূল্যে সেই বীজ পতিত জমি রয়েছে এমন পরিবারের মানুষের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। কিভাবে বীজ বপণ করতে হয় তা-ও শিখিয়ে দেন। কখনও কখনও নিজের খরচে বাল্য বিবাহ ও যৌতুক বিরোধী লিফলেট ছাপিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করেন। এ জন্য ইতিমধ্যেই তিনি মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘সাইকেল বাদশা’ নামে।

বিজ্ঞাপন
সচেতনতা বাড়াতে নানা শ্লোগান লিখে সাইকেলের সামনে পিছনে সেঁটে দিয়েছেন সাইকেল বাদশা। 

পরিবারের ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই বাদশা অন্যদের চেয়ে আলাদা। গ্রামের কেউ কোনো বিপদে পড়লে সবার আগে ছুটে যাওয়া তার নেশা। কাউকে হাসপাতালে নিতে হলে, ওষুধ কিনে আনার দরকার হলে বা বাজার থেকে জরুরী কোনো জিনিসের প্রয়োজন হলে ছুটে গিয়ে তা করে দেন বাদশা। এভাবেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয়পাত্র। তিনি নিজেই ছন্দ মিলিয়ে সমাজ সচেতনতামূলক নানা শ্লোগান লিখে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে সেঁটে দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এর পরিধি। এর পর আর্টিস্ট দিয়ে টিনের ওপর সাইনবোর্ড আকারে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও মাদকবিরোধীসহ সচেতনতামূলক নানা শ্লোগান লিখিয়ে গ্রামের বাইরেও সাঁটতে শুরু করেন। প্রায় বছর পনের আগে একটি সাইকেল কিনে তাতেই শুরু করেন মানুষকে সচেতন করার প্রচারণা। আর সেই প্রচারণার সঙ্গে সবজির বীজ বিতরণের কর্মকাণ্ডটি যুক্ত হয়েছে দশ বছর ধরে। ওই সময় থেকে তিনি বিনামূল্যে বিভিন্ন এলাকায় বীজ বিতরণ করে আসছেন। বিনামূল্যে বীজ বিতরণের জন্য এলাকার সবজিচাষির অনেকেই তাকে ভালোবাসেন। দেশের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক হানিফ সংকেত ২০১৭ সালে তাকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে পুরস্কৃত করেন।

চাষিদের অনেকেই বাদশার বিনামূল্যে বীজ বিতরণের কথা জানেন। তারাই বীজ উৎপাদনের সময় বাদশার জন্যও বেশি করে উৎপাদন করেন। সেখান থেকেই বিনামূল্যে মেলে বীজ। এর পর সেই বীজ প্লাস্টিকের বিভিন্ন বোতলে ভরে প্রতি মঙ্গলবার তাত বুনানোর সাপ্তাহিক ছুটির দিন তিনি বেরিয়ে পড়েন বিতরণ করতে। গত দশ বছরে তিনি বেড়ার অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক শ' বাড়িতে বীজ বিতরণ করেছেন। তিনি সবাইকে শিখিয়ে দেন কি করে কোন জায়গায় বীজ বপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কখনও কখনও তিনি নিজেই বিভিন্ন বাড়ির পতিত জায়গা খুঁজে বীজ বপণ করেন। বাদশা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ইচ্ছা থাকলেও দারিদ্রতার জন্য তিনি বেশি দূর আগাতে পারেননি। তিনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। তাঁত শ্রমিকের কাজ করে প্রতিদিন আয় করেন গড়ে ৪০০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

বাদশা জানান, যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম আমার মা পাড়ার সবাইকে লাউ, কুমড়া, শাক বীজ সহ অনেক রকম বীজ দিত। সেই থেকেই বিজ বিতরণ করা, গাছ লাগানো আমার নেশায় পরিণত হয়। কাজের ফাঁকে সাইকেল আর বীজ নিয়ে বের হই। আমার চাওয়া চারিদিক সবুজে ভরে উঠুক। পাশাপাশি ফাঁকা জমিকে কাজে লাগিয়ে অন্তত ব্যক্তিগত চাহিদা মিটুক।

হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ সরকার বাদশার ব্যাপারে জানান, বাদশা তার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে অসামান্য ভূমিকা রাখছে। তার অবদানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সবুজে ভরে উঠছে।

বেড়া উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি অফিসার নুর আলম বলেন, আমরাও সাইকেল বাদশার বিনামূল্যে বীজ বিতরণের বিষয়ে জানি। উনার এই মহতী উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে ওনার যদি বীজ বিতরণের ক্ষেত্রে কোন সহয়তা দরকার হয় উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ হতে যতটুকু সম্ভব তাকে সহায়তা করা হবে।