বরিশালে অবৈধ যানে কোটি টাকার বাণিজ্য
বরিশাল নগরীতে হঠাৎ করে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যানজট। বিভিন্ন সড়কে যানজটের তীব্রতায় প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। যানজটের মূলে রয়েছে ধারণক্ষমতার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি যানবাহন। তবে বেশিরভাগই অবৈধ যান।
বিগত দিনে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় এ সব অবৈধ যানবাহন ব্যাপক বিস্তার ঘটে নগরজুড়ে। এ সব অবৈধ যানবাহনের অধিকাংশের মালিকই আওয়ামী লীগ নেতারা। আর বাকি অবৈধ যানবাহন চলে পুলিশ বিটের মাধ্যমে। বর্তমানে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম কিছুটা ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে এসব অবৈধ যানবাহন বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরীতে। সরকার পতনের পরে বরিশাল জেলার গাড়িগুলোও ঢুকে পড়েছে নগরীর মধ্যে। এদের কোন ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। অপরদিকে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের বিভিন্ন দালাল দিয়ে প্রতি মাসে হয় কয়েক কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বরিশাল মহানগরীতে বৈধ গণপরিবহনের চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। বিআরটিএ'র অনুমোদিত ২ হাজার ৫০০ সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিপরীতে প্রায় ১৫ হাজার ইজিবাইক চলাচল করায় নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি পায়েচালিত রিকশাগুলোতেও মোটর যুক্ত করা হচ্ছে এবং সেগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো বরিশাল শহর। এই মোটরচালিত রিকশার সংখ্যাও ইজিবাইকের কাছাকাছি।
ফলে কেবল বরিশাল মহানগরীতে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ৩৮ হাজারেরও বেশি গণপরিবহন চলাচল করায় যানজটে নাকাল হচ্ছে নগরবাসী।পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পাকা সড়কের জন্য ইজিবাইকের ২ হাজার ৬৯০টি লাইসেন্সের নবায়ন বন্ধ রয়েছে ২০১৯ সালের জুন মাস থেকে। বিগত ২০২২ সালে সিটি করপোরেশন নবায়ন বন্ধ রাখা ইজিবাইকের লাইসেন্সের জন্য ফরম বিতরণ কার্যক্রম চালু করে। এতে তৎকালীন সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহসহ তার অনুসারীরা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
বরিশাল করপোরেশনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, এক সপ্তাহে প্রায় ১০ হাজার ইজিবাইক চালক এই ফরম সংগ্রহ করেছেন। ফরম বিতরণ শেষে তা যাচাই-বাছাই করে লাইসেন্স দেয় সিটি করপোরেশন। বিআরটিএ কিংবা সিটি করপোরেশন কোনো কর্তৃপক্ষই লাইসেন্স না দেওয়ায় প্রতিনিয়ত ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে এসব অবৈধ যানবাহন চালকদের সঙ্গে।
বরিশাল মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, বিআরটিএ কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অবৈধ ইজিবাইক, মোটরচালিত রিকশা ও থ্রি-হুইলার (মাহিন্দ্র) পুরো মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দ্রুতগতির যানবাহন এত বেশি চলাচল করায় দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা অবৈধ যানবাহন রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও বিভিন্ন সিন্ডিকেটের কারণে তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব যানবাহনের চালকরা। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এসব অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা গত কয়েক বছরে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝেমধ্যে মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগ এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য জরিমানা ধার্য কিংবা আটকের চেষ্টা করলেও তাতে কোনো সুফল আসছে না। ট্রাফিক বিভাগের জরিমানার হাত থেকে রেহাই পেতে এসব অবৈধ যানবাহন বিভিন্ন সংগঠন, সাংবাদিক, পুলিশসহ প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলাচল করছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, বৈধ ও অবৈধ এসব যান ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ, মালিক সমিতি, শ্রমিক কল্যাণ ইউনিয়নের ব্যানার, বিভিন্ন পত্রিকার স্টিকার ব্যবহার করে নগরীতে চলাচল করছে। অধিকাংশ মালিক ও চালক সড়কে 'প্রশাসনিক হয়রানি' থেকে রেহাই পেতে প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা মাসোয়ারা দিয়ে সড়কে গাড়ি চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব গণপরিবহনের অধিকাংশ বিআরটিএর অনুমোদন না থাকায় চালকরাও লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। আর অদক্ষ এসব চালকের কারণ প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
বিআরটিএর বরিশাল পরিচালক মো. জিয়াউর রহমান জানান, ইজিবাইক সরকার কর্তৃক অবৈধ যানবাহন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত এগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি বরিশাল মেট্রোপলিটনের বৈঠকে যানবাহন চলাচলের বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে এসব যানবাহন চলাচল বরিশাল সদর রোড এলাকা এবং পরবর্তী সময়ে আমতলা থেকে জিলা স্কুল মোড় পর্যন্ত আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়াও বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের কারখানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে সেগুলো সিলগালা করে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সম্পাদক রনজিৎ দত্ত জানান, বরিশাল নগরীতে প্রয়োজনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করায় দিনে দিনে এ সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান মিলে সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে আগামীতে বরিশাল নগরীতে আর চলাচল করা সম্ভব হবে না। এদিকে ট্রাফিক বিভাগের অভিযানে মাঝেমধ্যে ইজিবাইক আটক হলে নানা সংগঠনের ব্যানারে মহাসড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রুনা লায়লা বলেন, বিগত দিনে এসকল অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। তবে আমদের সার্জেন্টরা দলীয় চাপের কারণে অনেক সমস্যায় পড়তেন। আমরা আজ থেকেই অবৈধ যানবাহনের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, যে সকল ওয়ার্কশপে অবৈধ যানবাহন তৈরি করা হয় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা দরকার। এ বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করব।